♥♥প্রথম দেখার সেই রহস্যময়ী!♥♥

আমি মোটেও কচি খোকাটি নই। মধ্য তিরিশের পরিণত যুবক। জীবনের অলিগলিতে প্রচুর হেঁটেছি। মার খেয়েছি, পালিয়েছি, হোঁচট খেয়ে আবার উঠেও দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এমন আতান্তরে আর কখনো পড়িনি! প্রচণ্ড গরম পড়েছে। সামনে রাখা ঠাণ্ডা লেবুজলের গ্লাস মুহুর্তে ফাঁকা করে দিয়ে যখনই রাখতে গেছি, তখনই সামনের দিকে তাকিয়ে মনে হলোঃ আবার তেষ্টা পেয়েছে। এ পিপাসা অন্য পিপাসা!

কিছু দিন আগের কথা বলি। মমিনুর রহমানকে অনেকদিন বাদে ভাঙ্গামোড় বাজারে আবিষ্কার করে ফেললাম। আমি, সাদমান রাহী শহরেই থাকি। বহুদিন পর গ্রামে বেড়াতে এসেছি। থাকবো কিছুদিন। শহরের একাকী কাঠখোট্টা জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। তাই এই প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে আসা। কিন্তু মমিন ভাইকে যে পেয়ে যাবো, সেটা ভাবিনি! প্রায় বিশ বছর আগেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। আমার তখন কতইবা বয়স হবে? ১২ কিংবা ১৩ আর মমিনের তিরিশ? তখন একটা ঘটনা ঘটেছিলো যেজন্য মমিন ভাইকে ভোলা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব না! ফ্লাশব্যাকে সব মনে পড়ে গেলো।

এতদিন বাদেও লোকটার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি – কেবল কাঁচাপাকা চুলেই বয়স উঁকি মারছে! আমাকে দেখে চিনতে পেরে সে কি খুশী! নানান কুশল জিজ্ঞাসার পর বললেন, ‘বাড়িতে আসিস, সদু। চিনবি তো? ঐ যে বড় পাগারের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা গেছে, তার মাথায়…’
‘আমার মনে আছে’ জায়গাটা গ্রাম থেকে একটু দূরে ঘন জংলামত হলেও যাওয়া যায়। একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলামঃ
‘আমাকে মাফ করছো, মমিন ভাই?’
‘পুরনো সেসব কথা থাক, সদু। তাইলে আসিস কিন্তু, ভুলে যাইস না। একটা সারপ্রাইজও আছে’
‘হ্যাঁ, আসবো। কী সারপ্রাইজ?’
‘আসলেই দেখতে পাবি…এই শুক্রবার বাদ জুমা আয়…’

যথারীতি ভুলে গেলাম। মনে পড়লো পরের শুক্রবারে। ভাবলাম – গিয়েই দেখি, যেতেই তো বলেছে…পরের শুক্রবার – কী এমন তফাৎ?
দরজায় কড়া নাড়লে অনেকক্ষণ কারো সাড়া পাওয়া গেলো না। শেষে চলে যাবো এমন সময় অশীতিপর এক বৃদ্ধা দরজা খুলে রাগি চোখে তাকিয়ে রইল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিঃ তাঁর দুপুরের ঘুমটা হারাম করে ফেলেছি। কিন্তু এখন তো করার কিছু নাই!
‘কাকে চাও?’
‘আ…আমি সদু মানে সাদমান। মমিন ভাই বাড়িতে নাই? আমাকে আসতে বলছিলো…’
‘না, নাই। কালকে সকালে আসো। একটু ঘুমাইতেও পারি না, যন্ত্রণা!’

বুড়ির কোনো বোধবুদ্ধি নাই। মেহমানকে একরকম তাড়িয়েই দিচ্ছে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। উল্টো ঘুরে পা বাড়াতেই এক রিনরিনে গলার স্বর শোনা গেলো। ভেতর থেকে কে যেন বুড়িকে তিরস্কার করে উঠলো, ‘পরে ঘুমাও তুমি। ওনাকে ভেতরে নিয়া আসো। মেহমানকে এভাবে বিদায় দিতে নাই!’

কী সুন্দর কন্ঠস্বর! গনগনে রাগের আগুনে যেন জল পড়ে গেলো। এই মোহনীয় কণ্ঠের অধিকারিণীকে না দেখে কীভাবে যাবো– বুঝে উঠলাম না। বুড়ি কিন্তু তখনও জ্বলছে।
‘আসো, ভিতরে আসো। এইখান দিয়া সোজা যাও। ভরদুপুরে মেহমান? যন্ত্রণা!!’

ভয়াবহ গরম পড়েছে। ঝকঝকে লেপা উঠান তাওয়ার মত গনগন করছে। যে ঘরটিতে বসতে দেয়া হলো, সেটা পেয়েই মনে হলো, স্বর্গে বসে আছি। মাটির আধাপাকা ঘর। যত্নের ছাপ সর্বত্র। বাইরের আঁচ খুব একটা এসে পৌঁছাচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ… রুমালে ঘাম মুছছি। এমন সময় আট/নয় বছরের একটা মেয়ে এসে ঝকঝকে গ্লাসে করে খানিকটা লেবুর শরবত দিয়েই উধাও হয়ে গেলো। গ্লাসের শরীরে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমে আছে। আর তর সইল না। ঢকঢক করে এক চুমুকে গ্লাসটা সাবড়ে দিয়ে রাখতে গেছি, তখনই কাণ্ডটা হলো! কিন্নরকণ্ঠীকে দেখতে পাওয়া গেলো।

অসামান্য সুন্দর এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স আন্দাজ করা শক্ত – মধ্য বিশ অথবা সদ্য ত্রিশের কোঠায়ও হতে পারে। লালপেড়ে একটা শাড়ি বাংলা ধাঁচে পরনে। সেখানে একটা গ্রামীণ সারল্য থাকলেও শরীরী ঐশ্বর্য প্রবল উচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে একটা অন্যায় আনন্দের উৎস হতে চাচ্ছে! কাটা কাটা চোখ-নাক-মুখ। মুখে একটা অদ্ভুত হাসি – মৃদু কৌতুকের কি? আমার আবার বড্ড পিপাসা পেয়ে গেলো!

‘প্রথম দেখায় মরণ’ জাতীয় আদিখ্যেতা আমি বরাবরই অস্বীকার করে এসেছি। এসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয় না – এটা ভেবে অতীতে অনেক বিদ্রুপও করেছি। সেই আমিই কিনা… আমার মনে হতে থাকলোঃ আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেই রুপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হলো।

আমার এই আতান্তরে মেয়েটি বোধকরি ভিতরে ভিতরে বেশ মজা পেয়ে থাকবে। একটা দমকি হাসি হেসে বললোঃ
‘আপনি নিশ্চয়ই সাদমান ভাই? আমি শিরিন। মমিন সাহেবের স্ত্রী। আপনার কথা বলেছেন উনি’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হঠাত কি বলবো, খুঁজে পেলাম না। গলা খসখস করছে। পঞ্চাশোর্দ্ধ মমিনের এই বউ থাকাটা অষ্টম আশ্চর্যের ঠেকলো! কিন্তু এটা তো হতেই পারে – অস্বাভাবিক কিছু নয় – গ্রাম দেশে এমনটা  অহরহই ঘটে থাকে! অথচ তখন আমার মমিন ভাইকে খুব খারাপ মনে হয়েছিলো। আর একটা গনগনে ঈর্ষা!

দ্রুত সামলে নিলাম আমি। এসব কী ভাবছি? ভদ্রমহিলা মমিন ভাইয়ের স্ত্রী। মমিন ভাইয়ের কাছে আমি আজন্মের ঋণী – কীভাবে এই কুচিন্তা আসে আমার মনে? নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে বাস্তবে ফিরে আসি। একটু গলাটা পরিষ্কার করে,
‘আসলে মাফ করবেন এই ভর দুপুরে জ্বালাচ্ছি বলে। মমিন ভাই বলেছিলো আসতে…’  আমার গলাটা নিশ্চয় আধাভাঙ্গা ফ্যাসফ্যাসে শুনিয়ে থাকবে। মেয়েটা যেন আরো আনন্দ পেয়ে যায়। হাসতে হাসতেই বলে,
‘সেটা তো গত শুক্রবারের কথা। আপনি এলেন না; বেচারা খুব মন খারাপ করেছিলো’
‘আমার ভুলামন ভীষণ…সত্যিই তো, খুব খারাপ হয়েছে কাজটা। আজকেই মনে পড়েছে। আর কিছু না ভেবেই চলে এসেছি!’
‘হ্যাঁ, উনি তো আর জানেন না। নবাবের হাঁটে গিয়েছেন – আসতে রাত হবে অনেক’
‘ও, আমি তাহলে উঠি আজকে। বলবেনঃ আগামিকাল আসবো’

আমার এই তাড়ায় শিরিন ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

‘সে কী করে হয়? প্রথম এলেন আমাদের গরিবখানায়। এমনি তো যেতে দিতে পারি না – উনি রাগ করবেন। বসেন, আমাকে ঘন্টাখানেক সময় দেন’ বলেই বের হয়ে যায় শিরিন।

আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না – আশ্চর্য মেয়ে! এইমাত্র পরিচয় অথচ মনে হচ্ছে কতদিন ধরে চিনি! খানিকটা পায়চারি করে কাঠের শিকের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। দিনের আলো নিভে এসেছে –সূর্য ডুবছে। না, ভুল হলো। আকাশে মেঘ করেছে – কালবৈশাখী সম্ভবত। তখনি মেঘের গুড়গুড়ানি শুনতে পেলাম।

শিরিনের ছুটাছুটির কোনো কমতি নেই তাতে। আঁচলটা কোমরে গুঁজে ইয়া বড় একটা মাছ নিয়ে উঠানের একপাশে কাটতে বসেছে। ফর্সা মুখে পাশের চুলার আগুনের আঁচ লেগে আছে। কানের গোঁড়া থেকে হালকা কোঁকড়ান কিছু অবাধ্য চুল গালে এসে পড়েছে। প্রতিটা নড়াচড়া, কমনীয় ভঙ্গি আমাকে নিষিদ্ধ এক সুখে পাগল করে দিতে থাকে। আমার এই দীর্ঘ ব্যাচেলর জীবনে এই প্রথম সত্যি সত্যি কাউকে বড় একান্তে পেতে ইচ্ছে করে বসে!

জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। সময় যেন থেমে থাকে অসম্ভব একটা প্রাপ্তির মিথ্যা হাতছানিতে। একে না পেলে আমার বাকী জীবনটা বৃথাই হয়ে যাবে। কিন্তু এ যে অন্যায়! আমার কামনার অন্ধ পশুটি অবশেষে বিবেকের কাছে একটা চাবুক খায়। কাছে কোথাও কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ে। আমার আবার মনে পড়ে যায় সেই বিশ বছর আগের কাহিনি।

মমিন ভাই আমাদের বাড়িতে জায়গীর থেকে আমাকে পড়াতেন। ভীষণ স্নেহ করতেন। আমার নানান দুষ্টামির কারণে বাবার গাধা পেটানোর রাগটা প্রায় সময় মমিন ভাইই পিঠ পেতে নিতেন। সবসময় বলতেনঃ চাচা, ছেলেমানুষ – কী বুঝে? মাফ করে দেন। এই আশকারাতে কিনা আমি প্রায় উচ্ছন্নে চলে গেলাম। আজেবাজে বখাটেদের সাথে ভাব হয়ে গেলো বেশ। ওদেরই প্ররোচনায় একদিন দাদুর টাকা মেরে শহরে কিছুদিন ফুর্তি করার একটা আইডিয়া মাথায় আসে। বোকা আমি; ঠিক-বেঠিকের কোনো জ্ঞান ছিলো না। দাদুর যক্ষের ধন অনেকগুলো টাকা খাট-কাম-সিন্দুক হতে মেরে দিয়ে রাতের আঁধারে পালাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গুবলেট করে ফেলি। পালাতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়তে গেলে মমিন ভাইকে সামনে পেয়ে যাই। আহ, সেদিনের কথা এখনও ভালো মনে আছে। বেগতিক দেখে গোবেচারা মমিন ভাইকে সব টাকা দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ি। মমিন ভাই, আহ বেচারা টাকাগুলো নিয়ে আমার বাঘ বাপের হাতে ধরা পড়ে যায়।

তারপরের ঘটনা মনে করতে চাই না। যে অপমান, হেনস্থা, মারপিট গেলো…মমিন ভাই কিচ্ছু বললেন না। শুধু বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন সবাইকে। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। গরিবের মূল্যই নাই কোনো! শেষে অবশ্য থানা-হাজত হয় না। দাদু মারপিটেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান ব্যাপারটা। দড়ি দিয়ে সারারাত বেঁধে রাখা হলো তাকে। সেইরাত আমি ঘুমাতে পারিনি – সারারাত বাচ্চাছেলের মত কাঁদলাম। প্রতিজ্ঞা করলামঃ ভালো হয়ে যাবো। আমার জন্য মমিন ভাইয়ের এই ত্যাগকে সম্মান জানাবো।
শেষরাতে চুপি চুপি দড়ির বাঁধন খুলে দিয়ে তার পা ধরে মাফ চাইলাম। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ঠোঁটে কষ্টে একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘মানুষ হ! তোর প্রতি আমার কোনো রাগ নাই রে!’

পরদিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। সে নিরুদ্দেশ হয়েছে চুরির অভিযোগ মাথায় নিয়ে, দুঃখে, অভিমানে।

সেই মমিন ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে কীভাবে সে এরকম ভাবতে পারলাম? নিজের প্রতি একটা ঘেন্না চলে আসে। জানালায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানি না। হঠাত সম্বিৎ ফিরে আসে একটা চিকন মধুর কণ্ঠে,
‘এভাবে ভূতের মত দাঁড়ায় আছেন কেন? ঝড় হচ্ছে তো, ভিজে যাচ্ছেন। সরে দাঁড়ান। জানালা বন্ধ করবো’ বলেই মেয়েটা এগিয়ে আসে। ওর ঘাড়ের কাছটা অসাবধানে লেগে যায় আমার বুকে। অল্প একটু ছোঁয়া কিন্তু মনে হলো হাজার ভোল্টের একটা শক খেলাম। অতি সাবধানী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম,
‘স্যরি’
‘কেন?’ শিরিনের মুখে একটা অদ্ভুত কৌতুক হ্যারিকেনের আলোতে খেলা করছে। আমি কী বলবো, খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। শিরিনের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো। যেন আমার ভেতরের লোভিটাকে ঠিক চিনে নিয়েছে! কী বিপদে পড়া গেলো? কী চায় কী এই মেয়ে? সর্বনাশ না করে দেখি ছাড়বে না!
‘আসেন, খেতে আসেন। রান্না করেছি’
‘মমিন ভাইয়ের জন্য একটু অপেক্ষা করি?’
‘বললাম না, ওনার আসতে দেরী হবে। তাছাড়া এই ঝড়বাদল…মনেহয় আপনিও যেতে পারবেন না’ দাঁতে ঠোঁট চেপে একটা মাদক হাসি হাসতে থাকে।
‘না, না। সেটা ঠিক হবে না। লোকে কী বলবে? গ্রামদেশ এটা… আমি ঠিকই চলে যেতে পারবো’ আমি একটু জোরের সাথেই বলে ফেলি – কিছুটা উচ্চস্বরে।
‘আরে বাবা, ঠিক আছে। কে আটকাচ্ছে আপনাকে? চলেন, চলেন…খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে’ আবারও মৃদু হাসি লেগেই থাকে।

এলাহি আয়োজন। হ্যারিকেনের হলদেটে আলোয় খেতে বসেছি। বাইরে ঝড় হলেও একটা বিকট গুমোট ঘরটায়। শিরিন পাখা করছে। সেই রাগি বুড়িকে আবার দেখতে পাওয়া গেলো। কী একটা নামিয়ে রেখে আমার দিকে কটমট করে তাকাতে তাকাতে চলে গেলো। কী, সমস্যা কী এই বুড়ির? মনে মনে ভাবতে লাগলাম। খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলামঃ

‘কিছু মনে করবেন না, আপনাদের দেখা হয়েছিলো কীভাবে?’
‘মানে বলতে চাচ্ছেন ঐ বুড়া জুটলো কীভাবে আমার ভাগ্যে? এই তো?’
‘আরে সেটা কখন বললাম! আপনি তো আচ্ছা পেঁচুক…’
‘হ্যাঁ, ঐটাই ভেবেছেন, কেন খামোখা সাধু সাজছেন? তবে, শোনেনঃ কন্যাদায়গ্রস্থ এক বাবাকে উনি বাঁচিয়েছেন। মমিনের মত মহত লোক কমই আছে এই দুনিয়ায়!’
‘ওটা আমার থেকে কেউ ভালো জানে না’ আমি বলে উঠি।
‘তাই নাকি? আপনারও কাহিনি আছে নাকি? বলেন দেখি, শুনি’
‘আছে, তবে বলবো আর একদিন। আজ নয়’

আমার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। এমন পেট ভরে বাড়ীতেও খেয়েছি কিনা, সন্দেহ! মাটির ঐ ঘরে শুধু আমি আর সে। অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না। এক ধরণের অস্থিরতা পায়চারি করতে থাকে। আমার ভিতরের আমিটা ঠিকই জানি এ অস্থিরতার উৎস কোথায়? কিন্তু স্বীকার করতে অনিচ্ছুক! এবার আমি অস্বস্তিটা ভাঙ্গতে চাই। খুচরা কথা পেতে বসি।

‘আপনাকে কিন্তু গ্রামের মেয়ে মনে হয় না একদম। অথচ ভালোই কাজ করলেন। ঝটপট মাছ কেটে লাকড়ির চুলায় রান্না করে ফেললেন?’
‘আমি শহরে মানুষ। এখানে সব শিখে নিয়েছি। আচ্ছা এসব দেখলেন কখন? কেমন ঝিম মেরে জানালায় দাঁড়ায় ছিলেন!’
‘দেখেছি তো, সব দেখেছি – যাকে দেখার, প্রাণভরে দেখেছি’ বলেই একটা সূক্ষ অপরাধ বোধ করতে থাকি।

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শিরিন।

‘আপনি কিন্তু বেশ দুষ্টু আছেন… বন্ধুর স্ত্রীকে এভাবে দেখাতো ঠিক নয়!’
‘বোঝেন তাহলে? বুঝলে আমার পাও…না…টা?’ শিরিন আমাকে কথাটা শেষ করতে দেয় না। ঝট করে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘না’
‘কেন?’

আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। শ্বাস দ্রুতলয়ে চলতে থাকে। চিৎকার করে উঠিঃ

‘তোমার মত কাউকে পাইনি বলে। খুশী? কেমন এমন করছো? কেন আমাকে নিয়ে খেলছো? প্লিস, এই অন্যায় আমাকে দিয়ে করিও না। মমিন ভাইয়ের কাছে আমি আজীবন ঋণী। তার বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারবো না!’

হঠাত একটা দমকা হাওয়ায় হ্যারিকেনটা নিভে যায়। নিশ্ছিদ্র আঁধার। কে কোথায় আছে, কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। পাপি মন কিছু একটা চাপা আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। মন থেকে আপ্রাণ ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করি সবকিছু… কিন্তু আমার প্রতিরোধ সব গুড়িয়ে যায়… উষ্ণ একটা অপ্রতিরোধ্য আবেগ অধরের দুর্বিনীত স্বেচ্ছাচারীতায় গলে যেতে থাকে। স্থান-কাল-পাত্র সবকিছু আবার সেই সর্বনাশি আকাঙ্ক্ষার গর্ভে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি সাহসী হয়ে উঠতে থাকি – দুঃসাহসি, অদূরদর্শি। কামনার উদ্বেল উপত্যকায় অসহায় বন্দী! চষে বেড়াতে থাকি দেহজ আনন্দের খনি।

তবে, আমি নিশ্চয় একটু হলেও ঔচিত্যবোধ ধরে রাখতে পেরেছিলাম। পতনের দ্বারপ্রান্তে ফিরে দেখি বিবেকের মিটমিটে আলো। প্রাণপণে ঐ আলোটুকু ধরতে ধরতে ফিরে আসি কঠিন বাস্তবে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাই।  যাবার আগে কী মনে করে পিছু ফিরে তাকিয়ে ফেলি। শিরিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে…আলুথালু বেশ… বিদ্যুৎচমকের আলোয় যে মুখখানি দেখলাম, তাতে অনেকগুলো আবেগ একইসাথে আঁকিবুঁকি কেটেই চলেছে। কী নাই সেই মুখে? আহত অভিমান, বঞ্চনা, ক্ষুধা, ক্রোধ…সর্বোপরি…ভালোবাসা? ভালোবাসা! নাহ, এ সত্যি নয়। এ কখনো হওয়ার নয়!

ঝড় মাথায় নিয়ে আমি পথ পাড়ি দিতে থাকলাম। বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার।

চারদিন পরের ঘটনা।

ভাঙ্গামোড় বাজারে আবার মমিন ভাইয়ের সাথে দেখা। আমি একটু সামলে উঠেছি। তবুও মমিন ভাইকে দেখে অপরাধবোধটা চিনচিন করে উঠলো।
‘কী রে, এত করে ডাকলাম, গেলিই তো না!’
‘মানে?’
‘শুক্রবারে ডাকলাম… আসলি না তো! চল, এখুনি চল। বেড়াতে আসছিস, ভালো করে বেড়া’

আমার কোনো আপত্তি ধোপে টিকলো না! তাছাড়া কোনো এক অজানা কারণে বলতে পারলাম না যে চারদিন আগেই গেছি তোমাদের বাড়ি। শিরিন তাহলে কিছুই জানায় নি! যাক তবে, ভালোই হয়েছে। যা ঘটে ভালোর জন্যই ঘটে!

পথে যেতে যেতে নানান কথা হতে থাকে। কিন্তু সেদিকে আমার মন একেবারে নাই। খালি হ্যাঁ, হুঁ করে যাচ্ছি। মনে মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। শিরিনের সাথে আবার দেখা হবে…অবচেতন এই আনন্দ কোনোভাবেই চেপে রাখতে পারছে না! কোনো মানে হয়? থেকে থেকে বুকের রক্ত ছলাত করে উঠছে। এরই নাম কি প্রেম? দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে শেষে কিনা মমিন ভাইয়ের বউই পেলাম? মনে যুগপৎ আনন্দ আর বিষাদ নিয়ে পৌঁছে যাই অবশেষে।

মাটির আধাপাকা সেই ঠাণ্ডা ঘরটিতে আবার বসে আছি। সারপ্রাইজ দিবেন বলে ভিতরে গেছেন মমিন। আমি মনে মনে হাসছি – তোমার সারপ্রাইজ তো জানি।

খানিক বাদে পর্দা উঠিয়ে মমিনুর রহমান ঢুকলেন। পিছনে পিছনে একটা আড়ষ্ঠ মেয়ে গুটি গুটি পায়ে আসছে। আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।

‘সদু, এবার ফেরার সময় একটা কাজ করে ফেলছি। হাসিস না ভাই। আমি একটা বিয়ে করে ফেলেছি। বিশ্বাস কর, এই বয়সে… কিন্তু ওরা এত করে ধরলো…ফেলতে পারলাম না… এই শিরিন, সামনে আসো তো। এ তোমার ভাইয়ের মত – লজ্জা কিসের?’

ভাইয়ের মত আমি? শিরিনের কাছে আমি ভাইয়ের মত? অজান্তে একটা হাসি চলে এলো মুখে। মেয়েটি সামনে এলো।

কিন্তু এ কী? এ তো শিরিন নয়! এ অন্য মেয়ে। মাথায় এখন একটা বাজ পড়লেও এত অবাক হতাম না! আমার হাসিটা অকস্মাত মিলিয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বিষম ভাবনায় পড়ে গেলাম। মাথাটা কি দুলে উঠলো? এ কথা কাকে বলি? তবে, আমি কাকে দেখলাম এই চারদিন আগে? একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। অবশেষে মেয়েটি মুখ খুললোঃ

‘আপনি নিশ্চয়ই সাদমান ভাই? আমি শিরিন’

সেই একই কিন্নর কণ্ঠ! তবে, চেহারাটা একেবারেই ভিন্ন। এ শিরিন আমার সেই শিরিন নয়… আমার সবকিছু গুলিয়ে যেতে লাগলো! এ আমি কাকে দেখেছিলাম ঐ ঝড়জলের রাত্রে?

জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে! আমি আজও সেই ঘটনা ভুলতে পারি নাই। আমি এখনও অবিবাহিতই আছি। এখনও কোনো কোনো ঘোরলাগা আঁধারে সেই অধরার তপ্ত অধর ছুঁয়ে ফেলি। তাকে পাবার জন্য অবুঝ মন গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে। আমি যে সত্যিই প্রথম দেখায় শিরিনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম!

☼সমাপ্ত☼