:::স্টিলেটোস(Stilettos):::

চার বছর কি খুব বড় কোনো সময়? আবার নিশ্চয়ই তেমন ছোট সময়ও নয়! একই ছাদের নীচে একটা লোককে জানতে কত দিন লাগে? অরণি আসলেই এর উত্তর জানে না! কত দ্রুত সময়গুলি গড়িয়ে গেলো! অথচ এখনও ঠিক মন পেলো না সেজান -এর। কত কিছুই তো করে। কী খেতে ভালবাসে, কী পরে, কোথায় যেতে পছন্দ করে ইত্যাদি নানান ব্যাপার অরণির নখদর্পনে। কিন্তু তবুও সেজান ওর হয় না!
আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেলো বেড়াতে এসেছে মামাত বোনের বাসায়। এ ক’টা দিন একবারও নিজে থেকে ফোন করে নি সেজান । অরণিই যেচে ফোন করে খবর নিয়েছে। এই নিস্পৃহতার পেছনে যে অব্যক্ত চোরা গ্লাণিটা আছে, সেটা অরণি বুঝেও বুঝতে চায় না।
আনমনা হয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিলো অরণি। ভুলেই গেছিলো রাস্তার পাশে প্রকাণ্ড শপটায় উইণ্ডো শপিং করছিলো। বড় কোনো জুতোর শপ দেখলেই অরণি থেমে যায়। ঐ দেখাই সার। জানে কখনো কেনা হবে না। অত সাধ্য আছে নাকি তার? সেজান -এর টাকায় সে অবশ্য অবলীলায় কিনতে পারে, কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বোধহয় বলতে পারবে না। তাই কী আর করা, শুধু দেখেই যাও! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণি।
সব জুতোই যে ওর পছন্দ হয়, তা কিন্তু নয়। এক জোড়া স্টিলেটোস বহুদিন ধরে কিনবে কিনবে করেও কেনা হচ্ছে না। না, তার নিজের গরজে নয় – সত্যি বলতে গেলে সেজান -এর আগ্রহের জন্যই কিনবে। লোকটা স্টিলেটোস বড় পছন্দ করে। সোহানার পায়ে নাকি অদ্ভুত মানিয়ে যায়! হুম, সোহানা। নামটা মনে হতেই আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস টুপ করে ঝরে পড়ে।
সোহানা সেজান -এর অরণি পর্বের আগের কাহিনি। সব চুকেবুকে গেছিলো প্রায় বছর পাঁচেক আগে। এক তরফা সম্পর্কচ্ছেদ – সোহানার দিক থেকেই। বিয়ের আগেই সেজান ওকে সব জানিয়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কারণটা উদ্ধার করতে পারে নি। প্রত্যাখানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে যে রাগের মাথায় অরণির সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে সেজান, এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলো অরণি। কিন্তু করার খুব বেশি কিছু ছিলো না। মামার আশ্রয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হওয়া একটা মেয়ের বলার কি খুব বেশি কিছু থাকতে পারে?
বোঝাবুঝির আগেই একদিন প্রকাণ্ড যন্তরের পাখিটা ওদের নিয়ে আকাশে ডানা মেলে দিলো। গন্তব্যঃ বিভুঁই।

ভিন দেশে অরণি আতান্তরে পড়ে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হয় বাইরের শীতল প্রকৃতি যেন সম্পর্কের শীতলতার কাছে নস্যি! সেজান ঠিক রূঢ় শীতল ব্যবহার করে না ওর সাথে। কিন্তু উষ্ণতাও যে নেই, এটাও ধ্রুব সত্যি। আর মাঝে মাঝে সোহানা আসে। নানান কথায়, তুলনায়। ইচ্ছাকৃত কিনা, কে জানে? পায়ের সৌন্দর্য নিয়ে এক ধরণের অবসেশান আছে সেজান -এর। তাই সোহানার পায়ে স্টিলেটোস হিলের প্রশংসা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। ওরকম সুন্দর পা নাকি দেখাই যায় না! আরো কত কী? আফসোস, অবসেশান থাকা সত্ত্বেও অরণির পায়ের দিকে কখনোই সেভাবে দেখে নি সেজান। সে কি এতটাই ফেলনা? ইচ্ছে করে এক জোড়া স্টিলেটোস কিনে একদিন দেখিয়ে দেয়!

এক্সকিউজ মি প্লীজ, আপনি কি বিশেষ কিছু খুঁজছেন? কোনো সাহায্য করতে পারি?
ঘোর কেটে যায় অরণির। তাকিয়ে দেখে উজ্জ্বল চোখের একটা তরুণ শপ এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় স্যন্ডি ব্লণ্ড চুল। ওর তন্ময়তা দেখে নিশ্চয় খুব মজা পেয়েছে। ফিকফিক হাসছে।
‘না, না আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ!’ এড়িয়ে যেতে চায় অরণি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
হেল্প করাই আমাদের কাজ। আসুন, আপনাকে আরো কয়েকটা দেখাই। কত সাইজ আপনার? উম…৫? এদিকে আসুন, দেখাচ্ছি।
এমন আন্তরিকতায় ‘না’ বলাটা অশোভন দেখায়। অগত্যা অরণিকে যেতে হলো। এই ফাঁকে ব্যাজ থেকে সে নামটা পড়ে নিয়েছে – এইডেন।
এইডেন হরেক রকমের স্টিলেটোস দেখিয়ে চলেছে। সেদিকে তেমন মন নেই অরণির। শেষ ক’বে কে এভাবে তাকে এমন উষ্ণ আন্তরিকতা দেখিয়েছে, মনে করতে পারলো না। ব্লণ্ড ছেলেটা অবশ্যই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু তা বাদেও কিছু একটা অরণিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
কেউ কি কখনো আপনাকে বলেছে – কত সুন্দর এক জোড়া পা আছে আপনার! যে কোনো স্টিলেটোসই মানিয়ে যাবে…
অপ্রস্তুত অরণি চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করতে থাকে।
‘আমার একটু তাড়া আছে, তাছাড়া পার্সটাও বোধ হয় ফেলে এসেছি। পরে একবার আসবো, কেমন?’ হড়বড় করে বলে বেরিয়ে যায়।
‘স্যরি, আমি আপনাকে অপ্রস্তুত করতে চাই নি। ইয়্যু রিয়েলি হ্যভ আ ফাবিয়েলাস পেয়ার আভ ফিট!’ পেছন থেকে হেঁকে উঠে এইডেন।

এভাবেই শুরু। ক’দিন পর অরণি কেন যে আবার সেই শপটাতে গেলো, সে এক রহস্য বটে! কীসের টানে? উইণ্ডো শপিং, স্টিলেটোস নাকি ঐ ব্লণ্ড ছেলেটা? কোনটা যে ঠিক, ঠাহর হয় না! এমন ভাবনায় পায়ে পায়ে পেছনে এইডেন এসে হাজির হয়।
‘কী? আজকে নিশ্চয় পার্সটা নিয়ে এসেছেন, নাকি? কোন্‌টা নেবেন? আবার দেখাবো?’ সকৌতুকে জিজ্ঞেস করে এইডেন।
কাজের থেকে খুচরো কথাই হয় বেশি। জানাশোনা ডালপালা মেলতে থাকে সন্তর্পনে। কিন্তু এবারও জুতোটা কেনা হয় না অরণির। যাওয়ার সময় এইডেন জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার নামটাই তো জানা হলো না, মিস্‌?’
কীভাবে নিশ্চিত হলেন আমি মিস্‌ – মিসেস্‌ও তো হতে পারি।
হোয়াটেভা(র)…কী নাম তোমার?
কাল বলবো। হেসে ফেলে অরণি।
‘কাল আসবে?’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এইডেনের চোখ! কিন্তু অরণি কিছু বলে না। কী একটা আনন্দ দুই চোখের তারায় ঝিকিমিকি খেলতে থাকে।

দিনটার গায়ে শত বর্ণের প্রলেপ লেগে যায়। নদীর ধারে রাস্তাটা ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকে। ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যায়। নতুন করে জীবনটা কি আবার শুরু করা যায় না? দমকা হাওয়ার মত আকস্মিক এই চিন্তাটায় থমকে দাঁড়ায় অরণি। কেন এমন ভাবছে?

বেলা পড়ে এসেছে। শীতের এই বিকেলগুলোতে ঝুপ করে নেমে আসে আঁধার। রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিলো অচেনা কতগুলি পাখিকে। হটাত সেগুলি ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায়। বিষন্ন হয়ে যায় অরণি। সবারই ঘরে ফেরার তাড়া; শুধু তারই নেই! তার ঘর থেকেও হলো না কেন? নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা সর্বগ্রাসি ঢেউ উঠেও যেন মিলিয়ে যেতে বসেছে।

হঠাত মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। কে আবার, এই সময়ে? বিরক্তিভরে স্ক্রীনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সেজান ওকে ফোন করেছে? আশ্চর্য হলেও ফোনটা ধরে না। বেজে বেজে ভয়েস মেলে চলে গেলো। কানে লাগিয়ে শুনলোঃ একটা ভরাট কণ্ঠে শুধু দু’টি শব্দ – কোথায় তুমি? এতদিন পর শুধুই দু’টি শব্দ! আর কি কিছুই বলার নেই? কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে বড্ড প্রতারিত মনে হয়। কিন্তু দোষটা কাকে দেবে সে – ঠিক বুঝে উঠলো না!

সেজান বড় অবাক হয়ে যায়! অরণির মামাত বোনকে ফোন করে জেনে নিয়েছে সেই সকালে নাকি বেরিয়েছে। ফোনও ধরছে না। দু’সপ্তাহ হতে চললো সর্বশেষ কথা হয়েছে। সব সময় অরণিই খোঁজখবর রাখে। শুধু এবারই ব্যতিক্রম। অবজ্ঞার খুব গভীরে কোথায় যেন একটা উদ্বেগের বুদবুদ ভেসে ওঠে। কী হলো মেয়েটার? এই ভাবনাটার জন্য নিজের উপরই এক প্রকার চটে ওঠে সেজান।

সমস্যাটা বোধহয় আস্থার সংকট। বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মত সোহানার মুখ ফিরিয়ে নেয়া সেজানের বিশ্বাসের জায়গাটা একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। কাউকে আপন করে নিতে এখন তার বড্ড ভয় হয়। পেয়ে হারানোর ব্যথাটা সে বোঝে। তবুও একটা চেষ্টা সে একবার নিয়েছিলো। অরণিকে আসলে অপছন্দ করার কিছু নেই। চমৎকার মেয়ে; সাবলীল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু নিজের করে নিতে পারলো কোথায়? এতগুলি বছর বোধহয় বৃথাই গেলো। আসলে কি তাই?

বাসায় ফিরে অরণি কিছুই খেলো না। রুচি উবে গেছে। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ-ওপাশ করতে থাকলো। দু’চোখে ঘুম নেই। বুকের ভেতর যেন একটা আজব ম্যাচ চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বী – সেজান আর এইডেন। কার পক্ষ যে নেবে, এটাই বুঝে উঠছে না অরণি। প্রচণ্ড টানাপোড়েনে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষটায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সিদ্ধান্ত অবশ্য নেয়া হয়ে যায়।

সকাল থেকেই একটা অদ্ভুত শূন্যতায় পেয়ে বসে সেজানকে। কী যেন একটা খোয়া গেছে – এরকম একটা ভাব। নিজের মনকে বোঝালোঃ আর পাঁচটা অভ্যাসের মত অরণির অস্তিত্বও এক রকম। যেন প্রিয় একটা আসবাব বেখেয়ালে হাতছাড়া হয়ে গেছে! এই ভাবনাটায় এক প্রকারের স্বস্তি অনুসন্ধান করে সেজান। কিন্তু প্রবোধের প্রচ্ছন্ন অসারতায় খুব গভীরে গিয়ে ঠিকই অলখে জব্দ হয়ে যায়!

দুপুর নাগাদ ভেতরে ভেতরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সেজান। মোটে তো ১৫০ মাইল! হাইওয়ে ধরে গেলে কত লাগবে? চলেই যাবে নাকি? হঠাত গিয়ে চমকে দিলে খুব কি ছেলেমানুষি হয়ে যাবে? চুলায় যাক সব দ্বিধা! সেজানের হাতে আলগোছে সি আর ভি –এর চাবিটা উঠে আসে।

শেষ বিকেলের ক্ষণজন্মা মধুর আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে অরণিকে। নদীর ধার ঘেঁষে রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশ ক’জোড়া কৌতূহলী চোখ কখনো আড়চোখে, কখনোবা সরাসরিই তাকিয়ে আছে। সেইসব চোখে নিখাদ মুগ্ধতার সাথে কড়কড়ে অসভ্যতা থাকলেও আজ কিছুই গায়ে মাখে না অরণি। আজ বড্ড আনন্দ হচ্ছে। হঠাত মনে হয় – প্রশংসাকারি চোখগুলি কি এক প্রকারের জীবন্ত আয়না নয়? বন্ধনের বদ্ধ জলে নিজের অপরূপ তরঙ্গটাই তো ভুলতে বসেছিলো!

জুতোর দোকানে গিয়ে জানতে পারলো এইডেন আজ আসে নি। আশ্চর্য! গতকাল তো বলেছিলো আজ আসবে… মনটাই খারাপ হয়ে যায়। শুধু তার সাথেই কেন এসব ঘটে? পেয়েও সব খোয়া যায়।

শীত আরো জেঁকে বসেছে। বাইরে বেরিয়েই জ্যাকেটের হুডটা তুলে দিলো। আনমনে পথের হলুদাভ ঝরা পাতাগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিলো। ঠিক যেন তার মতই বিবর্ণ! হঠাত দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়! কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখে স্যন্ডি বণ্ড চুলে ঢাকা উজ্জ্বল চোখে রাজ্যের দুষ্টুমি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এইডেন। তার হাত দু’টো অরণির সরু কোমর ঘিরে শক্ত আকর্ষনে ব্যস্ত!

অদূরে বিনা কারনেই(!) কারো ক’টা হার্টবিট মিস হয়ে যায়!

এই আকস্মিক চমকে অরণির ভালো লাগতে থাকলেও সে দ্রুত বিবেচনা ফিরে পায়। ঝট করে কিছুটা রূঢ়ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে থাকে। এইডেনের চোখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাহনি। সে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে।

আ’ম স্যরি! কালচারাল ডিফরেন্সটা আমায় মাথায়ই আসে নি। কিছু মনে করো নি তো!
‘না, ঠিক আছে’ অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় অরণি।
‘আমরা কোথাও বসি যদি তোমার আপত্তি না থাকে?’ জিজ্ঞেস করে এইডেন।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
হেসে ফেলে অরণি। এইডেনও হাসে। পাশের একটা ক্যাফেতে দু’টো গরম কফি নিয়ে দু’জনে বসে পড়ে।
কী কথা হয়, কে জানে? তবে, মাঝে মাঝে বাঁধ ভাঙ্গা কিছু হাসি আর পরিবেশের প্রাঞ্জলতা বলে দেয় অনন্য কিছু সুন্দর সময় যাপনের কথা। কী আশ্চর্য অরণি এতো সুন্দর হাসতে পারে? কই কখনো তো খেয়াল করে নি! সেই হাসিটুকু কেন ওর নিজের নয় – এই ভাবনাটার প্রবল যন্ত্রণাকাতর ঈর্ষায় পুড়তে থাকে সেজান। এ এক নতুনতর অভিজ্ঞতা। সোহানার পর কেউ কখনো এমন প্রবল যন্ত্রণায় ফেলতে পারবে – এই কিছুক্ষণ আগেও যে ভাবতে পারে নি।

অরণি হাত বাড়িয়ে এইডেনের একটা হাত ধরে ফেলে। দু’জন খুব কাছাকাছি চলে আসে। এ কী চুম্বনও হয়ে যাবে নাকি? সেজান আর ভাবতে পারে না। মাথায় দপ করে একটা ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে ছেলেটাকে দুইটা বসিয়ে দেয়। কিন্তু আগুনটা যেমন ফট করে জ্বলে ওঠে, তেমনি অকস্মাৎ নিভে যায়। কোন অধিকারে করতে যাবে সেটা? এই চার বছরে উপেক্ষার গ্লাণি ছাড়া আর কী দিয়েছে সে অরণিকে? তার অপরাধের তো সীমা পরিসীমা নেই। নিজের ব্যর্থতার ঝাল মিটিয়েছে চমতকার মেয়েটির উপর। অথচ এটা কি ওর প্রাপ্য ছিলো?

ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যেতে থাকে সেজানের। অনেক চেষ্টা করেছে অরণি। কীসে মন পাওয়া যাবে সেজান –এর? সেজান বরাবরই এসব শীতলতার সাথে নিয়েছে। আত্মিক যোগসূত্রে বাঁধা পড়তে চায় নি ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায়। আহ্‌, কী নিদারুণ অন্যায়! এখন সেই মেয়েটি যদি মনের মত কাউকে খুঁজে নিতে চায়, তাতে কীভাবে দোষ দেখে! বরং সব দোষ নিজের – মেনে নেয় সেজান। তারপর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এঞ্জিনটা চালু করে। ফিরে যাবার পথ ধরে।

প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে থাকে এইডেন। সেটা বোধগম্যতায় নাকি অবুঝ আব্দারের শোকে – ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু অরণির চোখ সেদিকে নেই। হঠাত ওর দৃষ্টি আটকে গেছে পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সি আর ভি টার দিকে – কেমন যেন পরিচিত! দ্রুত লাইসেন্স প্লেটটা পড়ে দম আটকে যায়। এ তো ওদের – কীভাবে এখানে এলো? তার মানে সেজান কি…? আর ভাবতে পারে না অরণি। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। অল্প ক’টা কথায় বিদায় নিয়ে পা বাড়ায়। সময় বেশি নেই!
‘একটু দাঁড়াও, এটা তোমার জন্য এনেছিলাম। প্লীজ, না বলবে না’ এইডেনের চোখে আর্তি।
কী এটা?
একটা ছোট্ট উপহার – এক জোড়া স্টিলেটোস। তোমার পছন্দ হবে। শুধু তোমার আর …… জন্য।

ফাঁকা জায়গাটা ফাঁকাই রেখেই দেয় এইডেন। যে যার মত বসিয়ে নেয় যেন। অরণি ক্ষণকালের জন্য চেয়ে থাকে। একটা নামহীন সম্পর্কের জন্য কেমন একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকে। স্টিলেটোস জোড়া শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। হিলগুলির সুচালো ডগা বুকের খাঁচায় গিয়ে বেঁধে যেন ওগুলো হিল নয়; একেকটা সত্যিকারের স্টিলেটোস ড্যাগার। দু’টো তীক্ষ্ণাগ্র ডগা যেন অরণির ঘটনাবিহীন জীবনকে এক লহমায় ঘটনাবহুল করে তোলে। কেউ দেখে না একটা সহজ চাওয়া কেমন দু’টো প্রাপ্তির বিপরীত ধারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতে থাকে… জীবনে চাওয়া-পাওয়াগুলো এতো জটিল হয় কেন?

নাগরিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রশ্নমুখর আমি

আমি ঠিক জানি না কে আমার প্রতিবেশী – কী তার নাম?
প্রায় প্রতিদিনই দেখি কৃষ্ণাঙ্গ এক মহিলা, মধ্য বয়সী
সাথে বাচ্চা, এক গণ্ডা কাচ্চা।
কেবল হাই হ্যালোই বললাম, এতদিন
কিছুই তো জানা হলো না – একটু গভীরে, ঈষৎ বিস্তারে।
আজব, সেও কভু শুধালো না!

রাস্তায় হাঁটছি, মোটেও নই একা
সাথে চলছে অনেকেই, মুখে রাজ্যের ব্যস্ততা মাখা।
অনেকেই চেনা – হোক মুখের চেনায় চেনা
তবুও কেউ কাউকে বলি না, ভালো আছো?
কারুর গরজ নেই, ছুটছে সবাই
বাঁচো, নিজে বাঁচো, পারলে মাড়িয়ে বাঁচো
নতুবা সময় নেই, জলদি কাটো!

অথবা, ঝুলছি পাতাল রেলে – বাদুর ঝোলা।
সকালের ঠাস-বুনন ব্যস্ততা,
এই যে অনন্যা, কতক্ষণ হয়ে গেলো দাঁড়িয়ে আছি খুব কাছাকাছি…
না, ভুল বুঝবেন না। চাইনি তার কাছে অশোভন কিছু
সাধ্যের অতীত, অযাচ্য অতিরিক্ত!
শুধু একবার হয়তো চেয়ে দেখতে পারতো,
হাতে ধরা পেপারব্যাকটা হতে পারতো ব্রাত্য!
কিন্তু সে চাইলো না; মুখে ধরে আছে হিসেবী নাগরিক দূরত্ব
চলছে এমনি হাল ফ্যাশনের সমাজ – আহ, জবরদস্ত কায়দাদুরস্ত!
রক্তমাংসের জলজ্যান্ত মানুষ আমি, নিদারুণ উপেক্ষায় ভাবি –
সেই জড় বইটি কি আমার থেকেও দামী?

আমি ঠিক জানি না আমি এমন কেন? কিংবা তোমরা এমন কেন?
কিসের নেশায় এই ছুটে চলা, নাভিশ্বাসে নির্মমতার পিছু পিছু।
কেন, কেন কেউ কাউকেই চিনি না, জানি না?
জানিনা আমি এমন করে চাই কেন?
আমি যে জানতে চাই আমার প্রতিবেশীটিকে, জানতে চাই তার নাম।
কিংবা মুখচেনা পথচারীকে হাসিমুখে বলতে চাই – কেমন আছো?
আর ঐ সুদর্শনাকে বলতে চাই – এই যে শুনছো?
ছুঁড়ে ফেলে মেকি উপেক্ষা এসো দু’দণ্ড কথা কই।
আমি চাই না মানুষের কোটি কোটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ
স্বার্থান্ধ জলে মানবতার ক্ষয়িষ্ণু অন্তরীপ।
জীবন এই এতটুকু,
এসো না সব ভুলে মিলনের গান গাই,
এসো নিরবিচ্ছন্নতার স্বপ্ন সাজাই।

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (অক্টোবর ২০১১)

ছোট গল্প: পুনর্ভব

প্রায় প্রতিদিনই তো রাত করে আমায় ফিরতে হয়। মধ্যরাতের শেষ বাসটিকে বিদায় জানিয়ে মিনিট পনেরোর পথ হাঁটছিলাম। জনবিরল রাস্তা; দু’এক জন পথচারি থাকেই তো। অথচ সেদিন কাউকে পেলাম না, আশ্চর্য! বাতিগুলোকে একটু ম্লান মনে হচ্ছে…কিন্তু তাই বা হয় কী করে? এবারে চোখটা দেখাতেই হবে আর কী ভেবে ভেবে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ মাটি ফুঁড়েই যেন একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। বুকটা অজানা কোনো একটা অস্থিরতা কাটিয়ে উঠে যেন স্বস্তি খুঁজতে চাইল। শীতের নিশুতি রাত; আপাদমস্তক গরম কাপড়ে মোড়া বলে ঠিক বুঝলাম না আমার কোনো প্রতিবেশি কিনা। আমি যেদিকে হাঁটছি ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে। বাহ্‌! ভালোই হলো ভাবলাম। তখনো জানতাম না কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

হাঁটতে হাঁটতেই দেখলাম আমার সঙ্গী পথচারিটি দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনছে। মনে হচ্ছে হাঁটার প্রতিযোগিতা বুঝি! আমিও কী মনে করে একটু গতি বাড়িয়ে দিলাম। চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম: তারও গতি বেড়েছে। এহে! এই রাতবিরেতে খেলতে চাও? ঠিক আছে, আমিও নাছোড়বান্দা। দ্রুত পা চালালাম…এখন প্রায় ছুটছি…সেও ছুটছে। তখনি ভুলটা করে ফেললাম-ডানে মোড়টা না নিয়ে সোজা যেদিকে পরিত্যক্ত একটা ইস্কুল আছে সেদিকে পা বাড়ালাম। মিনিট পাঁচেক ছোটার পর হুঁশ ফিরে এল-আমি এদিকে কেন? আজব! চারপাশে তাকাতেই গা হিম হয়ে গেলো। প্রায় বিশ গজ দূরে ‘সে’ ও দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক একি ভঙ্গি-আপাদ-মস্তক আমার কাপড়ে মোড়া, আমার চোখজোড়া যেন সেখানে বসানো, চশমাটাও আমারি…ঠান্ডার মধ্যেও একটা ঘামের বিন্দু শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে চাইছে। এ যে আমিই …শুধু তার মুখে লেগে থাকা একখানা ক্রুর হাসি ছাড়া। এমন আতান্তরে কখনো পড়িনি; পায়ের নীচে ক্ষয়াটে ধূসর মাঠ যেন দুলে উঠলো। চোখটা একটু বুজতেই যেন অতীতের কিছু দৃশ্য শাঁ শাঁ উড়ে গেল…এই একি মাঠ, ভয়ার্ত একটা মানুষের মুখ…ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ…অস্তিত্বের দখলদারিত্বে হেরে যেতে থাকা বিবর্ণ একটা সত্তা। আচমকা সব মনে পড়ে গেলো…অজানা থেকে এসেছিলাম…কৌতুহলে মানুষ হতে চেয়েছিলাম। অজান্তে শিকার করেছিলাম উদাসীন একটা মন কে। কে জানত তার বুকে এতটা কষ্ট ছিল! এ ক’টা দিন তাঁর মতই হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এতটা গভীর ক্ষত শুধু মানুষই বয়ে বেড়াতে পারে। বুঝতেই পারিনি ধীরে ধীরে পরাজিত হচ্ছিলাম! ঝুঁকে পড়া সেই আগুন্তকের ক্রুর হাসিটা হটাৎ কোমল হয়ে যায়! নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে ক্ষমা করে দেয় বুঝি। মানুষই বুঝি পারে এতটা দুর্বোধ্য হতে! এরপর আর কিছু মনে নেই আমার!

☼☼☼☼☼☼

ইস্কুলের মাঠে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম! বন্ধ হাতঘড়ির রেডিয়াম আলোয় তারিখটা দেখে আঁতকে উঠলাম! ইয়া আল্লাহ! ছয়মাস সাতদিন কোথা দিয়ে গেলো! কিছুই বুঝতে পারছি না। ধুলো ঝেড়ে দিক ঠিক করে হাঁটতে থাকলাম। একটা অন্য রকম বিষাদে মনটা ভরে আছে। কিন্তু কেন? মন বলছে সব জানি, কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না! আশ্চর্য!!

সমাপ্ত

একাকীত্ব

কখনো কখনো বড় একা হয়ে যাই।
কখনো কখনো নিঝুম প্রাতে,
চোখ মেলেই বিষন্ন হয়ে যাই!
ভালোলাগে না আলো, নিষ্ঠুর লাগে
নাগরিক চৈতন্যের নিত্য শ্রুত শব্দ!
আত্মার গভীরে জেগে ওঠে
ঘুমিয়ে থাকা শব্দহীন নির্বিবাদি সমঝোতা;
বুক ধড়াসে মনে পড়ে যায়-
আমি একা, বড় একা!

কখনো কখনো ভুলে যাই বেমালুম-
বিস্মৃতির অভিনয়, সুনিপুণ;
ভ্রমাশ্রয়ী মায়া-কল্প,
অসুখী অনবধানে গেয়ে ফেলে আত্ম-ব্যজস্তুতি!
প্রতিবোধনের অশ্রু আনমনে গড়িয়ে পড়ে,
হাহাকারে মনে বাজে নিঃসঙ্গতার নিগুঢ় ধ্বনি !

কখনো কখনো বড্ড ওলটপালট হয়ে যায়…
আপাত সুখী জীবনের চকচকে মোড়কে
চাপা পড়া দীর্ঘশ্বাস,
ক্ষেপা অঘটন হয়ে জুড়ে যায়!
ভেঙ্গে গেলে মোহ, গুড়িয়ে গেলে আত্মরম্ভ
সত্যের ক্ষারক জলে ক্ষয়িষ্ণু ‘আমি’ কে দেখি।
তখন বড্ড অভিমান হয়ে যায়…
জাগতিক বিধির সাধ্য কি
ছোঁয় আমার মর্মন্তুদ মৃদুল নিধি!
কখনো কখনো বড় নিঃস্ব হয়ে যাই
উদাসীনতায়ও মানে না মন,
শত প্রবোধেও উন্নদ্ধ উচাটন;
কখনো কখনো বেঁচে থাকাটাই
বড্ড উপদ্রব মনে হয়!!

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (এপ্রিল, ২০১১)

শব্দার্থঃ
অনবধান – অসাবধান
ব্যজস্তুতি – নিন্দার ছলে প্রশংসা
প্রতিবোধন – উপলব্ধি
নিধি – আধার
উন্নদ্ধ – উচ্চে বাঁধা কিছু এমন

প্রেমময় জলের স্মৃতিকাতরতা

প্রমত্তা কিছু নদী মাঝে মাঝেই বিবসনা হয়ে যায়!
তাদের উত্তুঙ্গ জলবতী বুকে আমন্ত্রণের হাতছানিরা
আলতো ভাসে কামজ সকৌতুকে।
সাধ্য কী মরমর আকাশের? মুদে রাখে দু’নয়ন
জপে মালা নিষ্ফল নীতিকথার, উন্মন উদাসীনতায়?

নদীরা সব আশ্চর্য! কেমন করে জানি বুঝে ফেলে
চাপা তৃষ্ণা, কাঙ্খিত প্লাবনের রুদ্ধ আদিমতা।
তখন কোনো কোনো নদী বড্ড খেলুড়ে হয়ে যায়,
মুক্ত বহমান তরলের মত বয় সেইসব অনুপম দক্ষতা!
কেউ জানে না সত্যিকারের কী থাকে সেই রমণীয় ক্রীড়ায়?
শুধু ব্রাত্য যোগীর আর্ত প্রাণ আসে যায়!

তবুও সব দেখে শুনে আনমনে উথলে হাসি
উদাসীন প্রাণে – যেনো স্রেফ অপাপবিদ্ধ!
জলবতীরা কেলি ভুলে অবাক চেয়ে রয়!
কী করে জানবে ওরা? যোগীর বুকে যে শুধুই
একখানি অভিমানিনী জলের উন্নদ্ধ স্মৃতিকাতরতা!
যে একদা মদির নেশায় শুধিয়েছিলো,
– যোগী! নামবে আমার জলে?

সেই যে ক’বে ভিজেছিলো চরণ দু’খানা
সেই থেকে এখনো তেমনি অবুঝ প্রেমার্দ্রই আছে!!

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (অক্টোবর ২০১১)

উপহাস!

ভালোবাসা বড় নির্মায়িক ঘাতক
চেয়ে চেয়ে রক্ত ঝরায় কত নেপথ্যের চাতক!
ভালোবাসা তবু ক্রুর হাসে!
প্রাপ্তির পাতায় জোটে মোটে অলীকের পাওনা।
তবুও ভালোবাসা বলে, ‘বুদ্ধু, তেমন করে তো চাইলি না!’

হায় ভালোবাসা! কত অস্থির রাতের অবিরাম পায়ে চলা
মেটে না তৃষ্ণা – অবুঝ মন শত কৌশলী প্রবোধেও মানে না!
বারে বারে খুঁজে ফেরে অধরা।
কারো নিঠুর কৌতুকে কিংবা মিছে আবেদনের চাপা কুহকে
গড়িয়ে চলে কোনো প্রেমাহতের
ব্যথিত নিশি যাপন – পৌনঃপুনিক বাঁচা-মরা।
তবু ভালোবাসা বলে, ‘বুদ্ধু, তেমন করে আর মরলি কই!’

ভালোবাসা বড় কুটিল নিপীড়ক –
যুগান্তরের প্রাচীন মাদক।
কোনো কোনো হৃদয়-ঝড় স্রেফ দামামা বিহীন..
নিঃশব্দে ভাঙ্গে যত অক্ষম দলিত পাঁজর।
তবুও ভালোবাসা উপহাসে, ‘বুদ্ধু, তেমন জ্বালা আর সইলি কই!’

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম ( জুলাই ২০১২)

ঈপ্সিত হার!

আমি চাইলেই ভাঙ্গতে পারি এই বিকট নৈ:শব্দ
তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি জগদ্দল মুখবন্ধ।
চাইলেই বাজাতে পারি ধ্বংসের দামামা
গুড়িয়ে দিতে পারি যত ইতস্ততা – ব্যর্থতানামা!

আমি চাইলেই বলতে পারি কেউ নও আমার
ভুলতে পারি যত দাগ অবহেলার, উপেক্ষার।
চাইলেই হয়ে যেতে পারো আস্তাকুঁড়ের অতীত
সরিয়ে যত আবেগী জঞ্জাল – পৌনঃপুনিক হার জিত!

আমি চাইলেই সব পারি যেসব পারার কথা না!
হাসতে পারি আকর্ণ – বিদ্রুপে মাটি বেদনার হাঙ্গামা।
চাইলেই সব হয়, কিন্তু আমি যে সেসব চাইব না।
হেরেও জেতা যায় – আহ, সে বোঝে ক’জনা?

আমি চেয়েই হেরে যাবো, জিত আমার হবে না।
আমি তোমায় চেয়ে যে বিবাগী নক্ষত্র হবো…
তবুও যে তোমায় ভুলতে পারবো না!

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৩

মানুষ দেখার মত আনন্দ আর কিছুতে নেই!

আমি, আমি মানুষ দেখি।
তোমরা কী দেখো, জানি না।
আমি মানুষ দেখি।
আমি, আমি হেঁটে যাই পথে পথে,
থামি আপন মনে।
আমি ছুটি বাসে কিংবা ট্রেনে।
যেখানেই যাই আমি শুধু অবাক হয়ে চাই…
আমি আপ্লুত বিস্ময়ে শুধু মানুষ দেখি;
শুনি তাদের কথকতা, হাসি-কান্না,
বিদ্বেষ, ক্ষোভ, দীর্ঘশ্বাস আর নিষ্ফল বায়না!
তোমরা কী দেখো, বুঝি না
আমি কেবল মানুষের যাপিত জীবন দেখি।
আমি অপার আনন্দে মানুষের ভালোবাসা দেখি।
অথবা, কখনো কখনো কুঞ্চিত ঘৃণায়
মানুষের নীচত্ব দেখি!
পশুত্ব দেখি, দেখি পাশবিক লোভ-লালসা।
দেখি ভয়ানক মুখ ফিরিয়ে নেয়া, বিবেকের বন্ধ্যাত্ব!
আমি মানুষের ভণ্ডামি দেখি,
দেখি মুখোশের নিপুণ কারুকার্য
আমি চঞ্চল হয়ে পড়ি, বেদনায় হই নিঃসীম আর্ত!
তবুও আমি মানুষ দেখি,
ভালো হোক, মন্দ হোক…
পথে পথে ফিরি…
নানা খোলের মানবিক বিচিত্রতা আঁকি।
তোমরা কী দেখো, জানি না।
আমি মানুষের গভীর সেঁচে
অনুভূতির আনমোল মুক্তো খুঁজি!
আমি মানুষ দেখি।
মানুষ দেখার মত আনন্দ আর কিছুতেই যে নেই!

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (এপ্রিল ২০১৩)

অধরা শব্দের কাছে এক কাব্য-তিয়াসীর প্রার্থনা!

একটা কবিতা লিখবো বলে
কখন থেকে বসে আছি!
একটা শব্দের জাল বুনবো বলে
কখন থেকে কলম ভাঙ্গছি!
শব্দের উদ্ধত অপ্সরারা,
কীসে তোমাদের এত দেমাগ!
কেন তোমাদের এই নিঠুর খেলা
ব্রাত্য এই কবির সঙ্গে?
কেন তোমরা খেলো লুকোচুরি – নিত্যদিন?
কেন আসোনা এই বুকে…
ভুলে গেছ অযুত দিনের নিযুতসম ঋণ?
আমি বিনে কে বোঝে
তোমাদের অবিনাশি অপার যৌবন?
কে হাত বাড়িয়ে বলেঃ
এসো, উড়িয়ে দেই যোগ্য হৃদয়দেশে
তোমাদের অপাপবিদ্ধ মন!
একটা কবিতা লিখবো বলে
কখন থেকে শব্দের পিছে পিছে ঘুরছি…
প্রগলভা শব্দের তরুনীরা,
মিনতি করিঃ আর মিছে ঘুরিও না!
ধরা দাও, এইবার ধরা দাও এ বুকে…
শব্দ বিনে কবির বুক ধু ধু মরুভূমি
কাব্য বিনে কবির খাতা বেদনায় তামাদি!
একটা মনপবনের ঘুড়ি ওড়াবো বলে
কখন থেকে তোমাদের পিছু নিয়েছি…
দোহাই লাগে অপ্সরারা, আমায় তোমাদের
চরণরেখা চুমতে দাও…
তোমাদের ছন্দিল বক্রতা থেকে
ক’টা সুর দিলেইবা
পথের ধূলোয় অবহেলায় লুটিয়ে…
আমি উদাসীন কবি সেটাই নেবো বুক পেতে।
শব্দের লুব্ধক কামিনীরা,
আর আমায় বঞ্চিত করো না।
আমায়, আমায়…
এবার একটা কাব্যের ফুল ছুঁতে দাও!

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (মার্চ ২০১৩)

বোধোদয়!

এমনি করেই হয়তো কেটে যাবে বাকী দিন-রাত্রি
কেউ নড়বো না যেখানে যেমন আছি।
আত্মাভিমানের শিকড় গভীরে গেছে কত…
হৃত সময়ের শব্দ কেউ কি কখনো শুনেছি?

এমনি করেই বয়ে যাবে বহমান জীবন-নদী
শুধুই থাকবো চেয়ে, বলবো না কিছুই!
চোখেই শুধু ছোঁব গহীনের কথকতা – নীরবে,
ধরা দেবো না কেউই – অস্পৃশ্যই থাকবো…
কেউ কি কখনো বুঝেছি?

এমনি করেই হেঁটে যাবে বাকীটা পথ মিছে নির্মোহে।
কেন আসা হলো না কাছে, দীর্ঘ পথের সাথী?
কেন বলা হয়ে ওঠে নাঃ ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি!’
চাপা রোদনে কেবল দুটি অবুঝ হৃদয়ই ভাঙ্গে!

এমনি করেই আর কত কাল, কত কাল
বয়ে যাবে বিনাশী সমান্তরালে?
কেন মিলবে না দুটি বুক উষ্ণতার চাতক আলিঙ্গনে?
এমনি করেই কেটে যাবে যাপ্য যৌবন
আমরা নিশ্চয় বুড়ো হয়ে যাবো একদিন…
তারপর? তারপর……
কী লাভ এই দ্বন্দ্বে, পষ্টতায় নির্বিচারি অস্বীকারে?
আমরা কি একবার হ্যাঁ বলতে পারি না?
কেন মেলে না অযাচ্য সংঘাতি ব্যাকুল দুটি মন?

এমনি করেই কেটে যাবে অনাগত দিন-রাত্রি
একদিন আর সব হয়তো মিটে যাবে…
শুধু আমাদের চাওয়া – দ্বিধার বিচ্ছেদি কাঁটাতারে বাঁধা –
থেকে যাবে অমীমাংসিত!
আর কত বিক্ষত হলে আমাদের বোধোদয় হবে?

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (ফেব্রুয়ারি ২০১৩)