বিজনবাবুর লঘুদণ্ড

এখানটায় একটু বসতে পারি?

প্রশ্নটা শুনে বিজনবাবু বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।

এটা পার্কের পাবলিক বেঞ্চ। সবারই বসার অধিকার আছে। আমাকে অহেতুক জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? ইতোমধ্যে বিজন শীলের ভ্রুটা কুঁচকে গেছে।

তাতে অবশ্য আগুন্তুকের কোনো ভাবান্তর হলো না। একগাল হেসে ফেললেন।

স্যার মনে হয় বেশি কথা পছন্দ করেন না? ভদ্রতা করেই জিজ্ঞেস করেছি। আজকাল ভদ্রতা কিংবা সম্মান কেউ করে না, তাই না?

তা করবে না কেন? খুব করে। বামপাশেই তাকিয়ে দেখেন। লীলা চলছে, লীলা।

মধ্যদুপুরে একটা ঝোঁপের ফাঁকে কলেজ পালানো দুই তরুণ-তরুনী বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গ হয়ে বুঁদ হয়ে আছে একে অপরে। আশেপাশে কে দেখছে কোনো ভাবান্তরই নেই, লজ্জাও নেই!

সেদিকে তাকিয়ে আবারও হেসে ফেলল আগুন্তুক।

ওদিকে না তাকালেই হয়। আপনি দেখছেন কেন?

আমি দেখছি কেন? পোড়াচোখ এখনও সবই দেখে। আচ্ছা, নাই দেখলাম। কানে তো আর খাটো হয়ে যাইনি। রিটায়ার করেছি কিন্তু সব ইন্দ্রিয় তো দান করে দিইনি!

স্যার খুব সুন্দর কথা বলেন। কী পড়াতেন? বাংলা?

এই যে তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছেন, আপনি কে বলেন তো? বিজন শীল মোটা বাইফোকালের ভেতর দিয়ে উৎসুক মুখে চেয়ে থাকেন। আমার প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ নয়তো?

কেন, স্মৃতি কি ক্ষয়ে গেছে? ইন্দ্রিয় তো সব ঠিক আছে শুনলাম। হাহা।

দেখেন, এমনিতে আমার মেজাজ ভালো নেই আজকে। বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে বসে আছি এই জঘন্য প্রেমমঞ্চে। আমার সাথে মশকরা না করলেই খুশি হবো।

মাফ করবেন যদি মশকরার মতো শোনায় আমার কথা! আচ্ছা, ত্রিশ বছর আগে একটা দুপুর মনে করিয়ে দিই। তখন করিমগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলাই পড়াতেন। বছর দশেকের একটি ছেলে বাংলায় বড়ো কাঁচা ছিল। সে পড়তে আসত আপনার কাছে। আপনি তার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অনুরক্ত শব্দটার সঠিক প্রয়োগ হয়েছে তো, স্যার?

কে, কে আপনি?

তারপর একদিন সুযোগ বুঝে এমনি চৈত্রের কোনো এক দুপুরে আপনি তাকে জবরদস্তি করলেন।

এই, আপনি থামবেন? কীসব বকতে লেগেছেন? কে আপনি? চেঁচিয়ে ওঠেন বিজন শীল।

চেঁচাবেন না। কাহিনিটা শোনেন আগে। তারপর যুবক বিজন শীল বড়ো ঘাবড়ে গেল। ভয়ার্ত শিশুটিকে দেখে নিজের অনিবার্য পতন দেখতে পেলেন। অতঃপর দুহাতের জোর দেখালেন কচি গলার চারপাশে। জংগলের গভীরে পরিত্যক্ত কুয়ায় ফেলে দেবার আগে বিস্ফারিত চোখের ভাষাটা কি মনে পড়ে, স্যার?

কে, কে তুমি? তপন?

আমি কে সেটা ব্যাপার না! আপনাকে শুধু মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। খুব ভালো। স্মৃতিতে এখনও মরচে ধরেনি তাহলে?

বাবা তপন! আমাকে ক্ষমা করে দে, বাবা! আমার ভুল হয়েছিল। হাতজোড় করেন বিজন।

ক্ষমা? খুব সহজ না, স্যার? আমি চাইলেই আপনাকে চরম শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু সেটা করব না। আপনাকে গুরুপাপে লঘুদণ্ডই দিলাম। যান, লঘুদণ্ডই নিন। বিদায়!

পরের যা ঘটল তা স্রেফ ইতিহাস। আজকের টিকটক প্রজন্ম লুফে নিল দৃশ্যটা। ঘন্টায় লাখ ছাড়িয়ে গেল শেয়ার।

শহরের একমাত্র পার্কে মধ্য দুপুরে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে কিছু অত্যন্ত আপত্তিজনক কুরুচিপূর্ণ যৌন ভঙ্গীমায় দেখা গেল। বুড়োটা শূন্যের সাথে বেকুবের মতো কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে!

বিজন শীল সজ্ঞানেই সব করছেন। বেশ বুঝতে পারছেন কী করছেন, কিন্তু তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই! অন্যভুবনের কেউ যেন নিদারুণ রোষে সব করিয়ে নিচ্ছে।

বিজনের মনে হলো এর থেকে মৃত্যুই ভালো ছিল!

সাক্ষাৎকার

‘স্যার কি চলে যাচ্ছেন?’

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে বছর সাতাশ কিংবা আটাশের এক মেয়ের হন্তদন্ত মুখে প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন সদ্য চল্লিশের কোঠায় একজন সৌম্যদর্শন মানুষ।

প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে তিনি শহরের বেশ নিরিবিলি এই জায়গায়টায় অপেক্ষা করেছেন। তাঁর সময়ের দাম আছে। সময়ের অপচয় তিনি ভালোবাসেন না। তবুও অপেক্ষাটা করেছেন কারণ প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা রাখেন এ সময়ের প্রখ্যাত রহস্য গল্প লেখক অধ্যাপক আহমেদ হাসিব।

একটা ফোন অবশ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। তাঁর বিশ্বাস যা ঘটে, তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। রহস্য থাক বা না থাক। তিনি আগ্রহভরে অপেক্ষা করেন কখন সেটি স্বমহিমায় প্রকাশ পাবে।

‘হ্যাঁ, সেরকমই আমার ধারণা!’ ভারী কাচের চশমা ভেদ করে ভীষণ গাম্ভীর্য এনে দুই ভ্রু উঁচিয়ে উত্তর দিলেন আহমেদ। মেয়েটি হকচকিয়ে গেল।

সরি, স্যার। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার না কোনো উপায় ছিল না। সাক্ষাৎকারটা আমার খুবই দরকার। খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল অনসূয়া।

এবারে আহমেদ হেসে ফেললেন। চমৎকার ভুবনভোলানো হাসি।

এত লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। যদিও রিপোর্টার হয়ে দেরী করে আসাটা ভালো কথা নয়। কিন্তু আমি কিছু মনে করিনি। আমার আরেকটা জায়গায় যাবার কথা আছে। এজন্য আর অপেক্ষা না করে উঠে পড়েছি। কী যেন নাম আপনার?

অনসূয়া, স্যার।

হ্যাঁ, অনসূয়া এবারে তাহলে আর হলো না! আরেকদিন হবে, কেমন?

অনসূয়া শশব্যস্তে হা হা করে উঠল। আপনার বেশি সময় নিব না, স্যার। ঐ পার্কের পাশেই তো পার্ক করেছেন আপনার নিশানটা। ওখানে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হোক যদি অনুমতি দেন?

ভালোই নাছোড়বান্দা দেখছি আপনি! আচ্ছা, চলুন। পাঁচ মিনিটের বেশি কিন্তু আমি দিতে পারব না। ওকে, শুট!

শেষ বিকেলে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। পার্কের শতবর্ষী গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে কমলাটে কুসুম আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। এতক্ষণে ভালো করে খেয়াল করলেন অকৃতদার আহমেদ। মেয়েটি ভীষণ সুশ্রী। চমৎকার দেহসৌষ্ঠব। উচ্চতাও গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের থেকে বেশি।

আচ্ছা, শুরু করা যাক। স্যার, ভূত কি আছে?

সত্যি বলব? না, ভূত নেই! সব বাজে কথা।

সেকি, স্যার! ভূত-প্রেত নিয়ে লিখেই যাচ্ছেন প্রায় দশ বছর। এখন বলছেন, ভূত নেই!

দেখুন, লেখাটা একপ্রকারের মনোরঞ্জনের বিষয়। মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। যা সে জানে না, সেটা নিয়ে মানুষের নানান জল্পনা থাকে। আসলে আঁধারকে ভয় মানুষের। আমরা সেটিকেই ভাঙিয়ে খাই আরকি!

এটা কি অফরেকর্ড রাখব?

না, সবই ছাপতে পারেন। যারা বিশ্বাসী, তাঁদের আপনি এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়েও কিছুই বুঝাতে পারবেন না। আঁধারের ভয় এক অদ্ভুত জিনিস। ভয়ের সাথে তীব্র আকর্ষণও। ব্যাপারটা হয়তোবা শুরু হয় মাতৃজঠর থেকে। আঁধারের মধ্যেই তো ডুবে থাকি। অতঃপর আলোর সন্ধানে বের হয়ে আসি। তারপর কোনো এক অব্যখ্যেয় কারণে সব ভুলে যাই। অন্ধকারের প্রাচীন অভিজ্ঞতা তখন অজানা ভয় হয়ে চেপে থাকে।

তাহলে এই যে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নানা ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, সেগুলি শুধুই জল্পনা-কল্পনা?

হ্যাঁ, ভালো করে খতিয়ে দেখলে বুঝা যাবে, সবকিছুর পেছনে কিছু না কিছু কার্যকারণ আছে। ভূত স্রেফ কল্পনাপ্রবণ মনের আদুরে বিলাসিতা।

আচ্ছা, আপনার জীবনে কি কোনো ভৌতিক কিংবা অলৌকিক কিছু ঘটেছে?

টাইম ইজ টিকিং, ইয়াং লেডি! আর দুই মিনিট।

তাহলে দ্রুত বলেন। আমি বেশি সময় নিব না।

অনেস্টলি বললে, ভূতের দেখা আমি পাইনি এখনও। কিন্তু আমার কল্পনাটা আবার বড়োই বিস্তৃত। অসুবিধা হয় না। বরঞ্চ নিজের লেখা পড়ে বেশ বিস্ময়াভিভূতও হই মাঝেমধ্যে।

মানে বলছেন যে সবচে ভালো ভূতের গল্প আসে নিতান্ত ভূতে অবিশ্বাসীর কাছ থেকে? আপনার মতো একজন প্রথিতনামা লেখকের সৃষ্টি কিন্তু সেটাই নির্দেশ করছে।

আমার লেখার গুণ নিজে বিচার করতে পারি না! তবে, বলতে গেলে ব্যাপারটা সেরকমই। হাহাহা।

আচ্ছা, স্যার আর বেশি সময় নিব না। সময়ও নেই আমার! ক্লিক করে ছোট্টো রেকর্ডারটা বন্ধ করে অধ্যাপক আহমেদের হাতে দিয়ে দিলো অনসূয়া।

এটা তো আপনার রাখার কথা! আমাকে দিচ্ছেন কেন? অবাক হয়ে গেলেন আহমেদ।

স্যার, আপনার নিশানটা বোধহয় রাস্তার ওপারে। দেখুন তো একটু?

আহমেদ সেদিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওটাই আমার!

তারপর পাশ ফিরে আরও কিছু বলার জন্য ফিরে দেখলেন, অনসূয়া নেই। আজব ব্যাপার তো! কিছু না বলেই চলে গেল! বিদায় বলার সংস্কৃতি বোধহয় উঠে যাচ্ছে এখন। এমনই ঝপ করে আসে, ঝপ করে যায়। কী একটা অদ্ভুত জেনরেশন!

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আহমেদ আর দাঁড়ালেন না।

গাড়িতে বসেই একটা কল পেলেন সাপ্তাহিক রোমাঞ্চের সম্পাদকের কাছ থেকে। খবরটা শুনেই প্রচণ্ড ধাক্কায় বিহ্বল হয়ে গেলেন অধ্যাপক আহমেদ হাসিব। রহস্য বিষয়ক রিপোর্টার অনসূয়া আবেদীন সাক্ষাৎকার নেবার জন্য বের হয়ে গুরুতর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সৌজন্যবশত তাঁকে খবরটা জানালেন।

এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে একবারও অদ্ভুত অব্যাখ্যেয় কিছু ঘটেনি তাঁর জীবনে। তবুও নিরন্তর লিখে গেছেন কল্পনার জাল বুনে। আজ একটি ঘটনা সব ওলটপালট করে দিলো। এতক্ষণ কাকে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি? গায়ে একেবারে কাঁটা দিয়ে উঠল।

আহমেদ হাসিব সেই যে লেখা ছেড়েছেন, আর কোনোদিন কিছু লিখেননি। তবে, এখনও মাঝেমধ্যে রেকর্ডকৃত আলাপটা শোনেন তিনি। মেয়েটি তাঁকে এভাবে জব্দ করে চলে যাবে, ভাবতেও পারেননি কখনও! মেয়েটির জন্য একটা অদ্ভুত ভালোবাসা লালন করতে থাকেন তিনি।

ব্যত্যয় (Anomaly)

ক্রায়োজেনিক চেম্বারের স্বচ্ছ ঢাউস জানালা দিয়ে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে লিঙ্গমুক্ত দুনিয়ার দুই গবেষক – ১২১৩৯৩ এবং ১৯৬৪১৮।নামের প্রচলন বহু আগেই লুপ্ত হয়েছে। সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করাটা সরল এবং কার্যকর। আর সেই সাথে অনেক অনুভূতিও বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে।

অনুভূতির পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা তুলনামূলকভাবে একটি শিশু বিজ্ঞান। কয়েকজন প্রাচীনবাদী সত্তা সহস্র বছরের পুরোনো ধ্যানধারণার পুনর্জাগরণ চান। চরম মিনিমালিস্ট সমাজে এমন চিন্তা স্রেফ পেছনে হাঁটার নামান্তর হলেও তাঁরা থেমে থাকেননি।

এই গবেষণার জন্য অনন্ত ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে দুজন নরনারীকে। লিঙ্গ দিয়ে এভাবে ভেদাভেদ করাটা এখন হাস্যকর এবং কুরুচিকর হলেও ১২১৩৯৩ এবং ১৯৬৪১৮ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তাদের কাছে কাগজ নামক বিলুপ্ত একটা মাধ্যম দিয়ে বেশ কয়েকটা তথ্যভান্ডার এসেছে। প্রাচীন এক লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোকে নাকি বই বলা হতো। অদ্ভুত হেয়ালিপূর্ণ শব্দের সমাবেশ। তাদের মাথায় বসানো জেটাফ্লপ বায়োচিপ বাক্যে শব্দগুলির ব্যবহার বিশ্লেষণ করেছে।পারস্পরিক আকর্ষণজনিত উদ্ভট কথামালা! তবুও গবেষণার খাতিরে ভালোবাসা এবং কবিতা নামক ব্যাপারগুলো হজম করতে হচ্ছে ওদের।

এখন দেখা যাক কী হচ্ছে সেই ক্রায়োজেনিক গবেষণাগারে? ঘুম থেকে জাগানো দুই প্রাচীন নরনারী প্রবল আলিঙ্গনে রত। ছেলেটির কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল মেয়েটির ভরাট ঠোঁটের সঙ্গমে। অদ্ভুত সংক্রামক দৃশ্য! এসবের চল উঠে গেছে সহস্র বছর আগে।

কিন্তু হঠাৎ কী হয় বুঝা যায় না! ১২১৩৯৩ নিজের ঠোঁটে অজান্তে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলে। কোনো এক বিষম আলোড়নে সে কাঁপছে! ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে চোখ রাখে ১৯৬৪১৮। ১২১৩৯৩ কে কাছে টেনে আনে। নিছক অনুকরণই হয়তো!

অনন্য কৃত্রিম প্রাণ ইউ-০ রিপোর্ট লিখল।

সাংঘাতিক ব্যত্যয়! ১২১৩৯৩ এবং ১৯৬৪১৮ কে আশু কোয়ারিন্টিনে নেবার সুপারিশ করা হলো। অভিযোগ গুরুতর। নিষিদ্ধ বাতিল অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলেছে। সত্তার পোলারিটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কীভাবে প্রকাশ পেল, এটি যথেষ্ট কৌতূহলউদ্দীপক হলেও আরো নিবিড় পর্যবেক্ষণের দাবীদার।

ভালোবাসা এমনই। ব্যত্যয় হয়েও হয়তো বেঁচে থাকবে অনন্তকাল!

যতীনের ইলিশ

যতীনের একটা ইলিশ খাবার বড়ো শখ হয়েছে। তেলেতুলে একাকার আবার ডিমভরাও হতে হবে। রুপার মতো চকচকে ইলিশের চার আনা সাইজের আঁশগুলো বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলবে। মালতীর হাত থেকে আঁশবটিটা কেড়ে নিয়ে নিজেই পাখনা, লেজ আর মাথাটা কাটবে। ইলিশের মনকাড়া সুগন্ধী রক্তে রাঙা হাত একটু শুঁকেও নিলো সে এক ফাঁকে। মালতীর রান্নার হাত বড়ো ভালো। কিন্তু এই চ্যাপ্টা পাকা ইলিশটা সে নিজেই রাঁধবে। মাঝেমধ্যে খুব ভাবে থাকলে সে এই কাজটা করে।

এই যে হারামজাদা যতীন, এই গুঁড়ি গুঁড়ি বিষ্টিতে পথের মাঝে দাঁড়ায় থাকলে হবে? একটা মাছ টানতেই ক্লান্ত হয়ে গেলি? খেঁকিয়ে উঠলেন রহমত শেখ।

গম চুরির পবিত্র টাকায় শেখের ব্যাটা বিরাট হোমড়া-চোমড়া লোক। বাজারের সবচে বড়ো ইলিশটা তিনিই কিনেছেন। আর দেখিয়ে দেখিয়ে নেওয়ার জন্য ভাড়া করেছেন তাঁর গুদামের বস্তাটানা নিয়মিত মজুর যতীনকে। কিন্তু খেলাটা জমছে না ভালো। শালা থেকে থেকেই তাল হারাচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে খালি মিটিমিটি হাসে চোখ বন্ধ রেখে।

এ নিয়ে তিনবার এমন হলো। কোথায় উৎসুক জনতার মৎসজনিত প্রশ্নের জবাব যতীন দিবে তা না, ভাবুকসম্রাটের জন্য দুইবার তাঁকেই বলতে হলো। ভিতরে ভিতরে ম্যালা চটে গেলেন।

চারবারের বেলায় ধৈর্যচ্যুতি হলো। বাদলার দিনে এমনিতেই আলো মরে এসেছে অনেক আগে। ছাতা আর মাছসহ যতীন যথারীতি চোখ বুজে মিটিমিটি হাসছে। কাছে এসে কষে একটা লাথি ঝেড়ে দিলেন।

ছাতাটা ছিটকে পড়ল সাথে মহার্ঘ ইলিশটাও। রাস্তার কাদায় উল্টে যতীন মাখামাখি হয়ে গেল। দৃশ্যটায় বহুক্ষণের জমানো রাগ উপশমের মলম খুঁজে পেল যেন রহমত শেখ।

কিন্তু যতীন নির্বিকার উঠে দাঁড়াল। মুখের মিটিমিটি হাসিটা একটুও নিভেনি।

বাজান, লাত্থি দিলেন ক্যান? ভুইল্যা যাইয়েন না হাজার হইলেও আমি আপনার পোলা!

কী, কী কইলি তুই? তোর জিভ টাইন্যা ছিঁড়্যা ফেলমু!

আহা, রাগ করেন ক্যান? কাছে এসে মনে মনে দেখা ইলিশটার মতো রহমতের গায়ে হাত বুলাতে থাকে যতীন।

একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হতে থাকে রহমত শেখের। কোনো এক অব্যখ্যেয় কারণে তিনি আর  কোনো খিস্তি করতে পারছেন না। পেট আর পিঠটা কেন জানি সুড়সুড় করে উঠল। হালকা চাকা চাকা পুরো শরীর জুড়ে। নিজের শরীরের বেলিফুল আতরের তীব্র গন্ধ ছাপিয়ে একটা হালকা আঁশটে গন্ধ নাকে এসে ঘাঁই মারতে থাকল। যতীন সেরকমই ঘোরলাগা মিটিমিটি হাসি চালিয়ে গেল।

গভীর রাতে দুইদুইটা ইলিশ পেয়ে যারপরনাই আহলাদে গলে গেল যতীনের বউ মালতী। একটা ছোটো আর একটা বিরাট সাইজের। গায়ে চার আনা সাইজের আঁশ। ওটার মুখে আবার একটা সোনার চেন লাগানো।

তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে যতীনের মুখে একটা ঠোনা মেরে বলল, মরণ আমার, যতীন শেখের মাথা ঠিক আছে নি?

খুব অন্তরঙ্গ ভাবে থাকলে মালতী যতীনকে যতীন শেখ বলে ফেলে মাঝেমধ্যে।  

গল্পগুলি গাঁজাখুরি!

পিতা : কাপুচিনো

সকালে কাপুচিনো খেয়েছিল মুনিয়া। সে থেকেই তার পেটটা গর্ভবতীদের মতো বড়ো হতে থাকল। সকালে কাপুচিনো ছাড়া আর কিছু খায়নি সে। প্রচন্ড বিবমিষা। বিকেল হতে হতেই সে স্পষ্ট নড়াচড়া টের পেল। কে জানি একটা লাথিও মারল ভেতর থেকে।  মুনিয়ার পার্টনার চুন্নু একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। একসঙ্গে থাকার চুক্তিবলে চুন্নুর দ্বিমত করা বারণ। হাল সমাজে এমনই চলছে। চুন্নু মাথা দুলিয়ে বলতে থাকল, অবশ্যই কাপুচিনো খেয়েই তুমি গর্ভবতী হয়ে গেছ। এই সংবাদ সে বাইফাইতে (বায়ো ওয়াইফাই) দিয়ে দিলো। চুন্নু একজন প্রতিষ্ঠিত মূর্খ তার্কিক। তাই অন্য সবাই বলামাত্রই মেনে নিল। এই একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে কারও বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই। বাইজেনরা (বাইফাই এর বিদগ্ধ তালমার* সমাজ) সবাই অতি দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল যে নিশ্চিত ভাবে কাপুচিনোটাই অনাগত সন্তানের পিতা। ২০০০ : ১০ ভোটে তা সাদরে গৃহীত হলো। বিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভোটটা দিয়েছেন গন্ডমূর্খ উপাধিধারী প্রফেসর জগলু। বহু বছর আগে মগজের ফ্রন্টাল লোবের ঐতিহাসিক আরোপিত পরিবর্তন প্রমাণ করে তিনি হাসির পাত্র হয়েছেন। সিরামটা তাঁরই তৈরি। পুরো প্রক্রিয়াটাকে নয় ঘন্টার মধ্যে এনে ফেলেছেন। অথচ গর্দভগুলোর সেটা বুঝার ক্ষমতাই নেই। যুক্তি আর সমালোচনা এখন কাউকে করতে দেখা যায় না। তবে এই খেলাটায় তিনি বড্ড আনন্দ পান। এখন যেমন জংগলের মতো গোঁফের তল দিয়ে হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বলছেন – হ্যাঁ, কাপুচিনোটাই তোমার সব্বনাশ করেছে!

*তালমার সম্প্রদায় – যারা তেল মেরেও তালগাছটি আমার তত্ত্বে প্রাণপাত করে বিশ্বাসী।

প্রকৃতির ডাক

বিমানের আসনে বসামাত্রই মবিন মিয়ার পেটটা মুচড়ে উঠল। বিয়ানে সোয়াকেজি উঠানের ধারে আধাপাকা টাট্টিখানায় দিয়ে এসেছিল। এখন তো লাগার কথা না। তারপর ম্যালা কাঠখড় পুড়িয়ে বিমানে উঠেছে। মুসা মিয়া বাপেরে উঠায় দিয়েই চম্পট মেরেছে। মবিন মিয়া প্লেনের বামও বুঝে না, ডানও না! দরদর করে ঘামছে। বায়ুর নিম্নচাপ ছোটোবেলায় দেখা সাইক্লোনের তান্ডবের মতো ঠেকছে। আর পারল না সে। চটের থলে থেকে প্লাস্টিকের লাল বদনাটা বের করল। এদিকওদিক তাকিয়ে নিমেষে প্লেনের দরজাটা খুলে বাইরে গেল মবিন মিয়া প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। সবাই হায় হায় করে উঠল। এই ডাক যে একবার শোনে সে কি আর উপেক্ষা করতে পারে? খালি ত্যাগের আশায় শুধুই ঘামতে থাকে।

ছাগী

ক্যামডেন মার্কেটে বেশ কয়েকটা পুরোনো জিনিসের দোকান আছে। পার্থ জেনিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। জেনি নাকি কোনোদিন এখানে আসেনি। মেয়েবন্ধুর আবদার ফেলা দুঃসাধ্য! জেনির সবই ভালো কিন্তু অত্যন্ত ন্যাকামি করে। এত বিরক্ত লাগে মাঝেমধ্যে। এই এখন যেমন ইজিপসিয়ান ধাপ্পাবাজটার হাতে সিল খাচ্ছে। সাধারণ একটা আংটি উচ্চমূল্যে কিনে দিতে হলো। অতঃপর বেশ পুরোনো জিনিসে ঠাসা একটা নিরিবিলি আফ্রিকান দোকানে ঢোকা হলো। বেশি খদ্দের নেই! জেনি স্বভাবসুলভ আহ্লাদি করে এটা ধরে তো ওটা ছাড়ে। পুরো দোকান একেবারে তছনছ করে দেবার জোগাড়। একবার বহুমূল্য একটা শোপিস ফেলেই দিয়েছিল প্রায়। মোটামতো বৃদ্ধা দোকানি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে যেন এখনই ভস্ম করে দেবে। পার্থ গিয়ে সেই আগুনে লাইন অভ সাইট ভন্ডুল করে দিলো। হাজার হোক তার বান্ধবীকে সেই বুড়ির রোষানলে পড়তে দিতে পারে না।

এমন সময় জেনি চেঁচিয়ে উঠল। সে একটা ছাগীর মুখোশ পেয়েছে। সেটা সে পরে দেখতে চায়। মুখোশটার দিকে তাকিয়েই পার্থ নাক-মুখ কুঁচকে হেসে ফেলল। অত্যন্ত জীবন্ত যেন এখনই ম্যাহ করে উঠবে। মুখোশটা ধরামাত্রই বুড়ি তেড়েফুঁড়ে এলো। একগাদা সতর্কবাণীতে যা বুঝা গেল – সব জিনিস সবার জন্য নয়! জেনির এটা পরা যাবে না। সে বারবার একই কথা ভাঙা রেকর্ডের মতো বলতে থাকল।

কুসংস্কার পার্থ মোটেই মানে না। জেনিও না। বিত্তবান ঘরের আদুরী ভাবল দোকানি বিরক্ত হয়েই ভালো জিনিসটা ওকে দিতে চাচ্ছে না। সে যা চেয়েছে, বরাবর তা-ই পেয়ে এসেছে। ঐ ছাগীর মুখোশ তার চাই চাই-ই! পার্থ কিছুক্ষণ বুঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। ম্যালা বাকবিতণ্ডার পর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বৃদ্ধা রাজী হলো। ভাবখানা এরকম – মারা খেতে চাইলে খাও গিয়ে। আমার কী!

রাস্তায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করল পার্থ। কোন্‌ ফাঁকে জেনি যে মুখোশটা পরে নিয়েছে, খেয়ালই করেনি। মুখোশটা বেশ ভালোভাবে সেঁটে গিয়েছে জেনির মুখে। একটু বেশিই নিঁখুতভাবে। কলকল করে একটানা আগামাথাহীন কথা বলে যাচ্ছে জেনি। তাকে যে একটা আস্ত ছাগীর মতো দেখা যাচ্ছে এটা যেন সে খেয়ালই করছে না। অজানা আশংকায় বুকটা ধ্বক করে উঠল।

ছয়মাস পরের কথা। মানুষের নানান পোষ্য প্রাণির প্রীতির কথা শোনা যায়। কিন্তু একটা অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে কেউ একটা দুগ্ধবতী ছাগী পুষতে পারে, এ নিয়ে পার্থর প্রতিবেশীদের বিরাট কানাঘুষা। ওঃ, জেনি নামের আহ্লাদী মেয়েটাকে আর কোথাও দেখছে না কেউ! পার্থর কোলে থাকা ছাগীটা ম্যাহ্যাহ্যা করে উঠল।

কাকেদের একদিন

ঘন বরষার সন্ধ্যায় পাড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই শান্ত একটা কাক হয়ে গেল। কীভাবে এই রুপান্তর হলো, বুঝা গেল না। কেউ দেখতে পেয়েছিল কিনা তাও জানে না। অবশ্য অমন ঝুম বৃষ্টিতে নিমেষে জমে যাওয়া হাঁটু পানিতে একমাত্র শান্তর মতো আধাপাগলই সান্ধ্যভ্রমণে বের হবে। কিন্তু এত পাখি থাকতে কাকই কেন হতে হলো তাকে? কাকপক্ষীটাকে তার খুবই অপছন্দ। কেমন কুতকুতে চোখে তাকিয়ে থাকে। স্পষ্ট অনুভূতি হয় যেন পর্যবেক্ষণ করছে। এই কদিন আগেও গুলতি দিয়ে একটাকে লাশ বানিয়ে দিয়েছিল। যদিও ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে আরকি!

কাক তো হওয়া গেল, কিন্তু এই প্রবল বর্ষণে ভেজা কাক হয়ে থাকা ভালো ঠেকল না ওর। পাখা ঝাপটিয়ে বরই গাছের ডালে গিয়ে বসল। উড়তে বেশ লাগছে কিন্তু এই বৃষ্টিটা অসহ্য হয়ে গেল। একটু উষ্ণতা দরকার। সে তার কাকচক্ষু দিয়ে কোনো একটা পাখির বাসায় আতিথ্য গ্রহণের অভিপ্রায়ে ইতিউতি তাকাতে লাগল। বরইয়ের ঘন পাতা ভেদ করে কাছেই একটা বাসা দেখতে পেল। সেটা যে আরেকটা কাকের বাসা, এ সে কী করে বুঝল, কে জানে?

পুরুষ পাখিটি এগিয়ে এল। সাথে চোয়াড়ে চেহারার আরও দুটি কমবয়সী পাখি। অজানা কারণে ব্যাপারটা ভালো ঠেকল না শান্তর।

আপনাকে স্বাগতম যদিও আমরা আপনাকে চিনতে পেরেছি। কাকেদের নিয়ম অনুসারে আমরা আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি রাখব না। কিন্তু আপনাকে ছাড়বও না। শেষের বাক্যটি চোয়াড়ে চেহারার বাচ্চা কাকগুলি সমস্বরে বলল। শুনে শান্তর কাকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মানে কী এর?

গুরুতর জখম হয়ে বরইয়ের ডাল থেকে পড়ে যাওয়াটা শান্ত নিমেষের মধ্যে দেখে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ দুঘন্টায় যা চলছে তা অবিশ্বাস্য! শুকনো বরই পাতার আরামদায়ক কুশনে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। চোয়াড়েদের একটা কোত্থেকে দুটো জোনাক ধরে শান্তর তাকিয়ার সামনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তরতাজা কতগুলো কেঁচো খেতে দিয়েছে। কেঁচোটা গিলতে গিলতে শান্ত মনে মনে বলে উঠল, জীবন হয় সুন্দর!

তিনটি কাকই বিন্যাস আর সমাবেশ করে কা কা করে উঠল। যার মানে দাঁড়ায়, আমাদের পুরোপুরি জেন্টস ক্লাব করে ফেললেও আমরা কৃতজ্ঞ! ঘষেটি বেগম আমাদের জীবন জ্বালিয়ে খেয়েছিল। আয়েসে পাখা নড়াতে নড়াতে শান্তর মনে হলো গুলতি দিয়ে মেরে ফেলা কাকটা মহিলা ছিল সম্ভবত।

মাছি

মাছি মারতে গিয়ে একটা আস্ত মাছিই গিলে ফেলল রন্টু। এমন নয় যে সে হাঁ করে ছিল। একটা নীল মোটাসোটা মাছি চোখের সামনে ঠোঁটের ভাঁজ খুলে ঢুকে গেল। প্রাণিসমাজে আত্মহত্যার কথা অজানা নয় তবে একটা মাছি এরকম করবে তা অন্তত রন্টু ভাবতে পারেনি। মাছিটা গেলার পর রন্টুর আম খাওয়াটা লাটে উঠার কথা কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। বরং রমিজুন বিবি আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। তাঁর আমে অরুচি ছেলে নিজে থেকে দুটো আম চেয়ে নিল। এ খুশি তিনি কই রাখবেন?

আম-ঘুমে রন্টু দারুণ মত্ত। ফুলি ঘরের কাজ শেষে স্বামীর পাশে মাত্র শুয়েছে। এই ভরা দুপুরের নিরিবিলিতে একটু আদরসোহাগ সে চাইতেই পারে। সে রন্টুকে একটা মৃদু গুঁতো দিলো। সংকেত আরকি! রন্টু অভ্যাসবশেই একহাতে ফুলিকে টেনে বুকের উপর ফেলল কিন্তু তার ঘুম ভাঙে না। ঠোঁট ফুলায় রন্টুর অষ্টাদশী বউ। অভিমানে বুকের উপর কান পেতে দেয়।

মাছির একটানা ভনভন কারও অজানা থাকার কথা না। লোকটার বুক এবং নাক থেকে অবিকল সেই শব্দই আসছে।

বিকেলে হাঁটে গেল রন্টু আর তার ছোটো ভাই মন্টু। মাথায় এক ঝাঁকা আম। প্রচুর আম হয়েছে এবার। ভালো বিক্রির আশায় ফুলির জন্য একটা লাল ছাপা শাড়িও দেখে ফেলল সে। দিনের আলো কমে আসছে। মাগরিবের আজান পড়ে গেল। ঝট করে দাঁড়িয়ে রন্টুর মনে হলো সে কিছুই ভালো দেখতে পারছে না। দুহাতে চোখ কচলাল ভালো করে। সবই ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হচ্ছে। অবস্থা আরও খারাপ হবার আগে সে চিৎকার করে ডাকল, মন্টু আমারে বাড়ি নিয়া চল।

রমিজুন আর ফুলি বিবি দুজনেই সুর করে কাঁদছে। লেপা উঠানের মাঝখানে চিকন সুরের কান্নার রাগিনী ভেদ করে পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে চিন্তা করে দেখতে চাইল রন্টু। কিন্তু খুব অলসতায় পেয়ে বসেছে। ঝিমঝিমে ঘুমঘুম ভাব। এরই মাঝে ত্যক্ত করছে মতিন মুন্সি। অনবরত কীসব পড়ে যাচ্ছে, রন্টু ঝিমুনিতে কিছুই ঠাহর করতে পারল না। রাত বাড়লে মতিন তাঁর হাদিয়া নিয়ে পাট গুটালো বটে কিন্তু রন্টুর তেমন পরিবর্তন হলো না। পাকঘরের পাশে ঝুপড়ি লেবুগাছের পাতার নিচে জড়সড় হয়ে তাকে বসে থাকতে দেখে ফুলির কেমন ভয়ভয় করতে লাগল। ‘মানুষটা কি পাগল হয়া গেল?’

সবচে বড়ো অঘটনটা হলো এক্কেবারে কাঁচা বিয়ানবেলায়।  

গাইটাকে খড় আর পানি দিয়ে লাউয়ের মাচান থেকে শাক ছিঁড়তে গিয়ে আম বাগানের দিকে চোখ গেল ফুলির। প্রত্যন্ত গ্রামে বাগানের মধ্যে প্রকৃতির ডাক সারা সাধারণ বিষয়। ব্যাপার সেটা না। এই ভোরে ওখানে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মন্ডলের পো। সদ্য নিঃসৃত ধোঁয়া ওঠা হলুদাভ মানব বর্জ্য বিভোর হয়ে শুঁকছে রন্টু মন্ডল। ফুলি বিবি ওখানেই মূর্ছা গেল।  

রাত একটা বেজে একত্রিশ মিনিট

রাস্তায় পা দিতেই আকাশের এমাথা-ওমাথা ফালা ফালা করে বিদ্যুৎ চমকে গেল।

নিশুতি এই রাতে লোকজন বেশি থাকার কথা না। অভ্যাসমতো জয়নুল কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে ছোটো কাঁটাটা কোথায় আছে দেখার চেষ্টা করল। ভারী কাচের চশমাটা একটু আগুপিছু করে দেখে বুঝল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। কীভাবে বন্ধ হলো? সেদিনই না সাতমসজিদ রোডের মাথায় টাইম সিরিজ ঘড়ির দোকানে ঘড়িটা সারিয়ে আনল সাড়ে বারশ টাকা দিয়ে? মেকানিক ছেলেটা খুব দাঁত কেলিয়ে বললো, স্যার নিয়া যান, এক্কেরে নতুনের লাহান কইরা দিসি। এই তার নমুনা! ছেলেটা তাঁরই ছাত্র, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। দুনিয়া জোচ্চোরে ভরে গেছে একেবারে।

রাত দেড়টা দেখাচ্ছে। রাত দেড়টা? কীভাবে? একটু আগেই না বের হলেন? বিপত্নীক জয়নুল আহসান নিজের অসামাজিক খোলস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু নিয়াজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। আসলে নিমন্ত্রণ নয়, বন্ধুপত্নীর আত্নীয়াকে দেখানোই উদ্দেশ্য। বড়ো বিরক্ত হয়েছিল জয়নুল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে নাই। রিমির অকালমৃত্যুর পর একরকম নিজেই দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে খান হাত পুড়িয়ে। ভালো-মন্দ তেমন খাওয়া হয় না। তাই ভিতরে ভিতরে চটে গেলেও ওরকম এলাহি আয়োজনে হাসি-হাসি মুখেই বসেছিলেন। ওদের হাত থেকে ছাড়া পেতে পেতে রাত একটা বেজে গেছিল। সাতমসজিদ রোড ধরে মাত্র পাঁচ মিনিট হেঁটেছেন। তাহলে দেড়টা হবে কেন? ঘড়িটা কি আগে থেকেই বন্ধ ছিল?

হঠাৎ ভীষণ ধন্দে পড়ে গেলেন। পিছনের ঘটনাগুলি মনে করতে গিয়ে সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। অথচ ছোটোখাটো ব্যাপারগুলি উনি খুবই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে থাকেন। নোটও লিখে রাখেন। মনে পড়ছে বিয়ের কিছুদিন পর রিমির সাথে তাঁর বিরাট মনোমালিন্য এই নোট নিয়ে। বাসর রাতের পর নোটে লিখে রেখেছিলেন, ঈষৎ নাসিকাগর্জন সমস্যার কারণ হতে পারে যদিও নাকটা বাঁশির মতো আর পর্বতযুগলে সিমেট্রি নাই তেমন ইত্যাদি!

অনেক বছর আগের কথা মনে করে হেসে ফেলেও গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু স্মৃতি বোধহয় কোনো দিনই ফিকে হয়ে যাবে না। রিমিকে ভোলা অসম্ভব প্রায়! ঠিক তখনই খেয়াল করলেন ধূলির এক প্রকারের ঝড় উঠেছে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভাগ্যিস ছাতাটা সঙ্গে করে দিয়েছে ভাবি। এই তো ছাতার কথাটা দিব্যি মনে করতে পারছেন। ঘড়িটা কেন মনে করতে পারছেন না?

প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। বাংলা কী মাস এটা? আশ্বিন নাকি ভাদ্র? আবার দ্বন্দ্ব লেগে গেল। যেটাই হোক, এরকম ঘোর বর্ষা তো হওয়ার কথা না। ছাতাটা পুরোনোই বটে। ছাতার ফ্যাঁকাসে মেটে রঙের জীর্ণ কাপড়ের মধ্য দিয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির কণা চশমার কাচে দিব্যি জমে যাচ্ছে। বাইরে মোটামুটি তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রবল ঝড়ে গাছের মাথাগুলি যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে। বিপজ্জনকভাবে দুলছে। ও কী, ভেঙে পড়বে নাকি? ছাতার বাঁট শক্ত করে ধরে রাখতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময়ে ছাতাটা উড়েই যাবে।

রিমি মারা যাবার পর ইশ্বরে আর বিশ্বাস নেই জয়নুলের। বহুদিন প্রাকটিস করেন না। অথচ নিতান্ত অভ্যস্ততায় দোয়া ইউনুস বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন। চূড়ান্ত অন্যমনস্ক বলে বিপরীত দিক থেকে আসা অটোটা ঠিক খেয়াল করলেন না।

ঘ্যাচাং করে থেমে গেল অটোটা। সাথে একটা অশ্রাব্য খিস্তি। আর একটু হলে মাড়িয়ে দিচ্ছিল আর কি!

কৌতূহলে ছাতাটা কাত করে দেখলেন অমাবস্যার মতো কালো বদখত একটা লোক মাথাটা বাড়িয়ে গালির তুবড়ি ছুটিয়েছে। দোষটা তাঁরই। কোন্‌ বদ খেয়ালে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটছিলেন, কে জানে? জয়নুল কিছু বলেন না। শুধু মাথাটা নাড়িয়ে পাশের ফুটপাথে উঠে গেলেন। তখনই দেখতে পেলেন নেমে যাওয়া যাত্রীকে।

মিস রোজি। এক ঝলক দেখেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। এইসব সঙ্গ যথাসম্ভব পরিত্যাজ্য। কথাও বলতে চান না তিনি।

ফুটপাথের জায়গায় জায়গায় পানি জমে গেছে। ঝড়জলের রাতে ভিজে চুপসে যাওয়া হাজার পঞ্চাশ টাকা পঁচাত্তর পয়সার বাটা ছপ ছপ ছপ ছপ একটানা শব্দ তুলেছে। বামে মোড় নিলেন জয়নুল। রাস্তাটায় গাঢ় অন্ধকার এমনিতেই থাকে। রাতের বাতিগুলো অধিকাংশই নষ্ট। ঝড়ে অনিবার্য লোডশেডিং -এ আরও নিকষকালো হয়েছে আঁধার। হঠাৎ শুনতে পেলেন আরও একজোড়া পায়ের শব্দ দ্রুত তাঁর দিকে ধাবমান। কেউ কি দৌড়ে আসছে তাঁর দিকে? এ কী বিপদ?

কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা খিলখিল হাসি ছাতার নিচে চলে এলো।

স্যার, আমারে দেইখা পলাইলেন ক্যান? আমি কি বাঘ না ভালুক যে আপনারে খায়া ফালামু?

দামী সিল্কের শাড়ি, উগ্র প্রসাধন এবং সুগন্ধি আর দুর্বিনীত যৌবন… জয়নুলের এ মেয়েটিকে চেনারই কথা। তিনি যে পাঁচতলা বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেটার সবচে উপরের তলায় থাকে মেয়েটি। মিস রোজি এর নাম নয়; এই মেয়েটাকে তিনি ভালোই চেনেন কিন্তু বিচিত্র কারণে আসল নামটা মনে করতে পারছেন না।

বেশ খানিকটা উষ্মার সাথেই বললেন, মিস রোজি, তুমি আমার ছাতার নিচে এলে কেন? বেরিয়ে যাও এখনি।

মিস রোজির তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং দ্বিগুণ হাসিতে ফেটে পড়ল। ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লেন জয়নুল।

মিস রোজি! কী কইয়া ডাকলেন আমারে? স্যার কি আমার নাম ভুইলা গেছেন?

মধুর জলতরঙ্গ ঝড়জলের শব্দ ছাপিয়ে জয়নুলের কানে মধু ঢালতে লাগল। এ অন্যায়! নিজেকে মৃদু তিরস্কার করেন জয়নুল।

মিস রোজিই তো তোমার নাম ইদানীংকালে। ভুল বলি নাই। আর এরকম ভাষায় কথা বলবে না আমার সাথে।

কী ভাষায় কইতাছি? ওরে আমার বিশিষ্ট নাগর! (খিলখিল হাসি)

এই প্রকারের তারল্যে খুবই রুষ্ট হলেন জয়নুল।

তুমি এখনই বের হয়ে যাবে আমার ছাতার নিচে থেকে স্বেচ্ছায় নইলে…

নাহলে কী? ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন? দেন দেখি?

হাঁটা থামিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন মেয়েটির দিকে। ঠিক তখনই আকাশ চিড়ে আলোর ঝলকানিতে একটা বাজ পড়ল। সেই আলোতে অনন্যসুন্দর মুখখানি দেখেই চকিতে নামটা মনে পড়ে গেল। রুনু – হ্যাঁ রুনুই তো নাম!

রুনু! কেন এরকম করছ? এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

বহুদিনের অশ্রুত এ ডাকে মিস রোজি রূপোপজীবিনী ক্ষণকালের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে। অতঃপর দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে।

এত রাতে কোথায় গিয়েছিলাম? জানেন না কোথায় গিয়েছিলাম? আপনি বোকার মতো প্রশ্ন করছেন, স্যার।

ওহ সরি! তোমাকে ও প্রশ্নটা করা ঠিক হয় নাই। যাহোক, চলো এগুনো যাক। তাড়া আছে আমার। সময় নাই, পৌঁছাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।

মিস রোজি ওরফে রুনু যে প্রগলভতা নিয়ে ছাতার নিচে এসেছিল, তা নেই হয়ে গেল আলগোছে। এখন কেমন জড়সড় হয়ে হাঁটছে। দামী সিল্কের আঁচল প্রবল বর্ষণে বেশ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রায় এক দশক আগের অনুপম ফুল রুনুর ছবিটা হঠাৎ ভেসে উঠল। কীভাবে যে সব তছনছ হয়ে গেল!

তুমি আরেকটু ভিতরে আসতে পার। ভিজে যাচ্ছ তো?

আসব? আপনার বিশিষ্টতায় দাগ পড়বে না তো? বাজারি মেয়ে হয়ে গেছি আমি! অকস্মাৎ খুব করুণ শোনাল কন্ঠটা।

জয়নুল মরমে বিদ্ধ হয়ে গেল যেন বাজারি হওয়ার পেছনে সেও দায়ী। অথচ তা তো নয়। গল্প শোনার মানুষ নয় জয়নুল। কাটখোট্টা ধরনের। তবুও একটা ইচ্ছে যেন অস্থির আঁকিবুঁকি কাটছে। অথচ অদ্ভুত একটা ভাব হচ্ছে, মনে হচ্ছে সময় বেশি নেই। গল্পটা শোনা হবে কিনা বুঝতে পারছে না।

রুনু, কীভাবে এসব হলো?

মানে জানতে চাচ্ছেন কীভাবে রুনু চৌধুরি মিস রোজি হলো? কী লাভ এসব জেনে?

লাভ হয়তো নাই, কিন্তু বিশ্বাস কর দুই বছর আগে যখন তোমাকে প্রথম আবিষ্কার করলাম মিস রোজি হিসেবে, আমার উচিত ছিল সবটুকু জানাটা। এটুকু সৌজন্য তোমার প্রাপ্য ছিল। আমি সেটুকুও দিতে পারি নাই। কী এক প্রচণ্ড অভিমানে তোমার সঙ্গ এড়িয়ে চলেছি। তোমার কাছে যে আমার ঋণের শেষ নাই!

ছি ছি জয়নুল ভাই, এসব কী বলছেন! আমি আপনাকে কোনো দয়া করি নাই। আমি যে আপনাকে চেয়েছিলাম!

রুনু!!

কী, এই এত বছর পরেও আমাকে বকবেন? যেমন বকেছিলেন প্রথম ধরা পড়ার পর।

জয়নুল অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

স্যার, দোষ আমারই ছিল। আপনি পড়াতে এলে আমি শুধু আপনাকেই দেখতাম। কী ভীষণ মেধাবী একটা ছেলে ফিজিক্সের মতো চরম ফালতু একটা সাবজেক্ট পানির মতো বুঝিয়ে দিত! আপনার বুদ্ধিদীপ্ত স্বপ্নীল চোখ আর ক্যাবলাকান্ত হাসি… হায়, আঠারো বছরের একটা মেয়ের জন্য যে কী হতে পারে, সে বুঝার মতো মনই আপনার ছিল না।

এক্সকিউজ মি! ক্যাবলাকান্ত হাসি আবার কী? রেগে ওঠে জয়নুল।

বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই! গলিতে হাঁটুসমান পানি জমে গেছে। শো শো শব্দে আরও জোরে বাতাস ফুঁসছে। মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে আশেপাশে কোথাও। সেরকম একটা শব্দে আরও ঘন সন্নিবেশিত হয়ে যায় রুনু জয়নুলের। রুনুর গুরুভার বক্ষের স্পর্শে চমকে ওঠে জয়নুল! বহুদিনের অনাস্বাদিত রক্তমাংসের স্বাদ বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে যেন সহসাই উঠে আসে। কিন্তু জয়নুল কোনো অন্যায় সুযোগ নিতে চায় না। হোক সে হাইক্লাস রূপোপজীবিনী। প্রবল নিয়ন্ত্রণে চকিতে সরে আসে।

ও কী, ভয় পেলেন নাকি স্যার? খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রুনু। অভাবে দেহ বেচি ঠিকই, তবে আপনাকে ফাঁদে ফেলার কোনোই অভিরুচি নাই আমার।

না, না ভুল বুঝবে না।

না, আমি ভুল বুঝি নাই। চিরকালের আদর্শবাদী! আপনাকে একটা সময় খুব ঘৃণা করতাম জানেন?

এখন করো না?

নাঃ, সে মনই তো আর নাই। সব মরে গেছে। বাবা মরে যাবার পর আমাদের অনেক সম্পত্তি বাবার ব্যবসার ঋণ চুকাতে খরচ হয়ে যায়। বাকীটা আমাদের পারিবারিক শত্রুতার জেরে সব হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। আমার পড়া আর এগোয় না। পড়াশোনায় ভালোও ছিলাম না জানেনই তো। মা আর তিন ভাইবোন নিয়ে আমরা ছোটো একটা ভাড়া বাড়িতে উঠে যাই অন্য শহরে। সামান্য সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে দ্রুত। অতঃপর একদিন মা-ও…

আমাকে জানাও নাই কেন?

অভিমানে জানাই নাই! কী ছেলেমানুষ ছিলাম, তাই না? আপনি আমাকে প্রত্যাখান করেছিলেন। মনে আছে সে কথা? বয়সের ফারাকের দোহাই দিয়ে যা-তা বুঝিয়ে… আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আপনি এত পাষাণ কেন?

আজ এত বছর পর এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে জয়নুল? চুপ হয়ে থাকে। পথ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত চঞ্চল হয়ে ওঠে জয়নুল। কীসের যেন একটা তাড়া! অভ্যাসমতো কব্জি উলটে দেখে ঘড়িটা। এখনও থেমে আছে সময়।

রাস্তায় খানাখন্দ আগেই ছিল। এই আকস্মিক প্লাবনে সেগুলির ঠাহর করা মুশকিলই বটে! তারই একটাতে এই ঝড়জলের দুর্যোগে পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। হলোও তাই। কিন্তু সিনেমার মতো মেয়েটা পড়ল না। পড়ল জয়নুল।

ছাতাটা উলটে ভেসে গেল। কোনোমতে জয়নুলকে ধরে রেখে পানিতে পড়ে যাবার হাত থেকে বাঁচালো রুনু।

এবার কোমরটা ছাড়লে ভালো হয়। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রুনু।

অপ্রস্তুত জয়নুল তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে যায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরও জোরে চেপে ধরে।

অঝোর ধারায় ঝরে যাচ্ছে বাদল। রুনুর সিল্ক ভিজে একশা। লেপ্টে রয়েছে শরীরে। জয়নুলের চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। অদ্ভুত পরিবেশ – অদ্ভুত সময় – অদ্ভুত যোগাযোগ! দুটি ঠোঁট কখন যে কী আজন্মের উত্তর খুঁজতে থাকে, কেউ জানে না। বুঝতে পারে না। দুর্যোগের ঘনঘটা ভিতরে এবং বাইরে। জয়নুলের সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে গেল।

ধাতস্থ হলে দুজন ছিটকে যায় দুদিকে। কিন্তু পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। এ কি ক্ষণকালের মোহ নাকি বহুকাল আগের অবহেলিত অস্বীকারী দুর্নিবার আকাংখা? দুটি হাত কেমন চিরচেনা আশ্বাসে গভীর আশ্লেষে পরস্পর ডুবে থাকে।

গন্তব্য কাছে আসতে থাকলে জয়নুলকে বেশ আন্দোলিত দেখায়। পাঁচতলা দালানের সামনে এসে থেমে পড়ে। কড়াৎ শব্দে একটা বাজ কাছে কোথাও পড়ে। ঝটিতি হাত ছেড়ে দেয় জয়নুল।

প্রবল দুঃখভরে রুনু বলে, ওঃ, বুঝতে পেরেছি। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সীমানা!

জয়নুলের বুকটা হাহাকার করে ওঠে। তাড়াতাড়ি রুনুর হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরে। রুনু, ভুল বুঝো না! আমি তোমার উপরে অন্যায় করেছিলাম। সব বুঝেও তোমাকে প্রত্যাখান করেছিলাম অথচ তুমি তোমার সর্বস্ব দিয়ে আমাকে চেয়েছিলে। সব সঞ্চয় দিয়ে আমার পড়ার খরচও যুগিয়েছিলে। কেন করেছিলে? কেন, কেন? শোনো রুনু, সময় আর বেশি নাই। সত্যটা বলে যাই। আমি তোমাকে… রুনু জয়নুলের মুখে হাত রাখে।

বলতে হবে না, আমি জানি এবং বরাবরই জেনে এসেছি।

হঠাৎ জয়নুলকে বেশ শান্ত দেখায়। যত অস্বস্তি এবং দ্বন্দ্ব ছিল সব মিলিয়ে গেল কর্পূরের মতো। সব পরিষ্কার লাগছে এখন।

গেটের কাছে মাথা ঢুকিয়ে রুনু জয়নুলকেও ডাকে ভিতরে। কিন্তু জয়নুল নড়েন না।

তুমি যাও, রুনু। আর হয়তো দেখা হবে না! বিড়বিড় করে বলেন জয়নুল।

শেষ কথাগুলো শুনতে পায় না রুনু। যদি শুনতে পেত তাহলে দেখতে পেত যুগপৎ আনন্দ এবং বিষাদ নিয়ে কী অপার্থিব ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন জয়নুল!

অভ্যাসবশত কব্জি উলটে দেখে রেডিয়াম ডায়ালে মিনিটের কাঁটাটা এক মিনিট এগিয়েছে। একটা বেজে একত্রিশ মিনিট। জয়নুলের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।

একতলায় জটলা দেখে সামনে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে মিস রোজি। সিভিয়ার হার্টএটাকে এইমাত্র মারা গেছেন অধ্যাপক জয়নুল আহসান। দেয়াল ঘড়িতে একটা বেজে একত্রিশ মিনিট।

☼ সমাপ্ত ☼

♥চুপি চুপি♥

দাঁড়ান বলছি। এত তাড়া দিলে কি চলে? ঘটনাগুলি ঝটপট ঘটে গেলো।

চশমা কিনতে যাবে-এ উপলক্ষ্যে যে আমার ডাক পড়বে…কোনোদিনই ভাবি নাই! জীবনে বোধহয় এই প্রথম নাকের কাঁধে পাকাপাকি চেপে বসা দৈত্যটিকে বেশ ভালো লাগতে থাকল। সম্মতি জানাতে গিয়ে প্রায় তোতলা হয়ে গেলাম। হা ঈশ্বর, এসব কী হচ্ছে? মেয়েটি যদি বুঝে যায়? কোনোমতে বললাম: ‘ফ্রাইডে আফটারনুন –এ যাওয়া যেতে পারে’। হ্যাঁ সূচক একটা মাথা নাড়িয়ে মেইজিন চলে গেলো। আমার ভুলও হতে পারে…একটা অস্পষ্ট হাসির রেখা কি ছিল না ওর ঠোঁটে? বুকের কোথায় যেন কিছু একটা ভাংচুর আবার শুরু হল?

এরকমই হয়ে আসছে বেশ ক’টি বছর। হ্যাঁ, আপনারা যা অনুমান করেছেন তাই হয়তো ঠিক। আমি এই মেয়েটিকে একান্ত চাই…অবশ্যি একতরফা…এটাও নিশ্চয় বলে দিতে হবে না! নাকি অন্য কিছু একটা আছে, প্রচন্ড চাপা স্বভাবের মেয়েটিকে বোঝাই দায়…সত্য বলতে গেলে কথাটা আমার জন্যও খাটে বৈকি!

মেইজিন কে প্রথম দেখাতেই ভাললেগে গিয়েছিলো। আমার সহকর্মী ছিল। কিন্তু অনেকদিন পাশাপাশি কাজ করেও ঐ যে আপনারা যেটা ভালো জানেন, সেটা আর বলা হয়ে ওঠে নি। ইনফ্যাক্ট, কেউই বলতে পারে নি। সহজ ব্যবহারের মোড়কে একধরণের দুর্ভেদ্য দেয়াল ছিলো যেটার ভাঙ্গাটা অসম্ভবের নামান্তর ছিল। আপনারা হয়তো বলবেনঃ ‘এ আর এমন কী? ওরকম হয়েই থাকে। তোমার সাহসে কুলোয় নি!’ হবে হয়তো…কিন্তু বুঝতে বুঝতে বিচ্ছেদটা হয়েই গেলো।  মনে থেকে গেলেও ব্যস্ততার কারণে আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। সেদিন হঠাত করেই স্টেশানে দেখা হয়ে গেলো। কথায় কথায় জানলাম চোখে ভালো দেখছে না; আমি যদি সময় করে ওকে নিয়ে যাই? আপনারাই বলেন, আমি ওর জন্য সময় বের করতে পারবো না? এও কি হয়? টানা টানা চোখের দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া কী যেন একটা খুঁজছিলাম, নিজেও ভালো জানি না।

তারপর মাঝের দিনগুলি কীভাবে যে কেটে গেলো…ভয়ানক অস্থিরতা…কী পরবো, কী বলব…এইসব হাবিজাবি। একটু হাসিও পেলো। নিজেকে বললামঃ ওহে প্রেমের মরা, শপিং –এ সাহায্য করতে তোমায় ডেকেছে। আর তুমি কিনা…ছিঃ ছিঃ! সে যাই হোক, শুক্রবারের সকাল-দুপুরটা অফিসে যেন কাটতেই চাইছিল না। তার উপর সহকর্মী মহিলা জেমস বন্ড মেয়েটির অনুসন্ধিতসু চোখ নাচানিঃ ‘কি হে! আজকাল দেখতেই পাচ্ছো না বুঝি? তা, মেয়েটি কে শুনি, ওই যে আজ বিকেলে যাওয়ার জন্য হেঁদিয়ে মরছ?’

নিঁখুত অভিনয়ে আকাশ থেকে পড়ে বললাম, ‘ কি যা তা বলছ কারমেন, কোথায় আবার যাব?’
থাক, আর জঘণ্যতম অভিনয় করতে হবে না। ইয়েলো স্টিকি নোট এ নাম আর সময় লিখে মনিটরে সাঁটিয়ে পূজো করছো আর বলছো কিনা কী যা-তা বলছি হা হা হা। সত্যিই তাই তো! ভুলোমনের মাশুল আর কী! জিভ কেটে ২০ মিনিট হাওয়া হয়ে যেতে হলো। নইলে কারমেন কী জিনিস যে বুঝবে সে আজীবন মনে রাখবে।

মোবাইলে নক নক শুনে তাকিয়ে দেখি একটা মেসেজ এসেছে। মেইজিন। সে নাকি আমার জন্য স্টেশানে অপেক্ষায় আছে। হাউ সুইট! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে টেবলে হোঁচট খেয়ে গেলাম। অট্টহাসি শুনে কারমেন কে জায়গামত একটা রাম-চিমটির অবশ্য পালনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

বিশাল স্টেশানে ঘরফেরতা গিজগিজে মানুষের ভীড়ে কাউকে খুঁজে বের করাটা বিরাট ঝামেলার। মোবাইল করা যেতে পারে, কিন্তু করতে ইচ্ছে হলো না। অনুমানের উপর ভিত্তি করে গেইটের বাইরে কস্টা কফি’র আশেপাশে চোখ বুলালাম। আর তাতেই সুন্দরী চোখের ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেলো। একধরণের ছেলেমানুষি পেয়ে বসল; প্রতীক্ষায় ওকে কেমন দেখা যায় আর কী! আর সে দৃশ্য…একবার মোবাইল, একবার গেইটে। সুন্দর মুখখানায় বহু আকাঙ্খিত কাউকে স্পট করার শিশুসুলভ চাঞ্চল্য-বিরলই বটে! মনের ভেতর দুর্মুখ আমিটি বলে উঠলোঃ আবে গাধা, চশমা কেনা কীভাবে হবে এই চিন্তায় ব্যাকুল হয়েছে আর তুই কিনা ছিঃ ছিঃ! ‘ইয়্যু’ড নট বিলিইভ ইয়্যর আইজ, ইফ টেন মিলিয়ন ফায়ারফ্লাইস…’ মোবাইলের রিংটোনে সম্বিৎ ফিরে দেখি কল করেছে। আমাকে ওদিকটায় ডাকছে। আমার যা স্বভাব, ভাবনায় হারিয়ে গেলে তো খেয়াল থাকে না..দেখেই ফেললো নাকি?

তুমি বুঝি খুঁজছিলে আমাকে অনেকক্ষণ? আমি তো তোমাকে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।

নাহ, এই এই তো…এইমাত্র এলাম। দাঁড়িয়ে দেখছিলাম-এটা কীভাবে বলি আপনারাই বলুন। কিছু কিছু মিথ্যে সত্যের মত করে বলতে হয় নইলে উপায় নাই। টুকটাক কুশল বিনিময়ের ফাঁকে অপ্টিসিয়ানের কাছে যাচ্ছিলাম। বেশ বুঝতে পাচ্ছিলাম আগের মত স্বচ্ছন্দ আর নেই সে। কেমন আড়ষ্ট হাঁটছে। কিন্তু কেন? আমার উপস্থিতি…তবে কী?

তুমি আগের মতই আছো দেখছি! হুটহাট ভাবনায় ডুবে যাও; একটা এক্সিডেন্ট যে এতদিনে করে বস নি এটাই আশ্চর্য!

তা, এক্সিডেন্ট করলেই কী আর না করলেই কী? কেইবা ভাবছে বলো? এ দুনিয়াতে তো আমার বলার মত কেউ নেই!

সে কী! কেউ জুটেনি এতদিনে?

এখন তো মনে হচ্ছে এক্সিডেন্টে কাঁদবার জন্য হলেও একজন থাকলে মন্দ হতো না…হা হা হা।

মেয়েটিও হাসছে। এত সুন্দর লাজুক হাসি! হঠাৎ বড় শূন্য শূন্য লাগতে থাকলো। বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে ব্যথা। সেটা এই হঠাৎ প্রাপ্তিতে নাকি বহুকালের অপ্রাপ্তিতে-ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। এখন আপনারাই বলেন ঐ যে আপনারা কী যেন একটা বলাবলি করছিলেন সেটাই আমাকে পেয়ে বসেছিল কিনা?

চেংড়া অপ্টিসিয়ানটি সময় নিয়ে (একটু বেশিই হবে, আপনারাই বলুন, সহ্য হয়?) ছোটখাট সার্কাস দেখিয়ে একটা প্রেসকৃপশান ধরিয়ে দিল। দেখলাম এমন কিছু নয়; সেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এখন ফ্রেম দেখার পালা।

এত সুন্দর চোখ তোমার…সেগুলি কিনা এই হতচ্ছাড়াগুলি (চশমা) দু’হাত দিয়ে সারাক্ষণ আগলে রাখবে! উহ! ভাবতে পারছি না!

বুঝলেন আপনারা, জানি না কী ছিল এই কথায়…মেইজিন এতো মজা পেয়ে হাসতে থাকলো যে আশে পাশের কয়েকটা চ্যাংড়া ট্রেইনি এসে অযথা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কীভাবে তারা সাহায্য করে ওকে ধন্য করবে তাই বলে কান ঝালাপালা করে ফেললে। এমন কটমট করে চাইলাম যার মানে করলে দাঁড়ায়ঃ ‘ ভালো চাস তো কেটে পড় উজবুকের দল’। কীভাবে আমি এই কাজটি করতে পারলাম, সেটা আপনারাই বের করুন।

মেইজিন বলে – তোমার চোখও তো সুন্দর! তবে সেগুলি কেন লুকিয়ে রাখো? (মিটিমিটি হাসি)

আহেম, ইয়ে…সেটাও দেখতে পেয়েছো? আশ্চর্য! আনন্দদায়ক কিন্তু অপ্রস্তুত ভাবটা লুকোতে মেয়েদের একটা ফ্রেমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফ্রেমটা পরিয়ে দিতে গিয়ে ওর পুরো মুখটা আমার দু’হাতের মধ্যে হঠাত বন্দী হয়ে জমে গেলো। একটা বারংবার না বলা অচেনা আলো গভীর কিছু উপলব্ধিকে সহসা আলোকিত করে দিয়ে বিস্ময়ে যেন থির হয়ে আছে! আর আমি আবার হারালাম। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গভীরতম ভাষায় প্রাচীনতম বেদনার কথা নিমিষে কোন ফাঁকে জানিয়ে দিলাম, বলতে পারি না।

উড ইয়্যু লাইক টু গেট দ্যট ফ(র) ইয়্যর গার্লফ্রেন্ড, স্যর? আয় ক্যান টেল ইয়্যু ইট’ড বি আ পারফেক্ট ওয়ান ফ(র) হা(র)। সাথে গা-জ্বালানো একটা হাসি ফ্রী।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে, খানিকটা কেশে বললাম, ‘আমরা বন্ধু মাত্র, অন্য কিছু নয়’

ইয়াহ, উই ক্যান সী দ্যট ভেরি ওয়েল।

ফাজিল কোথাকার! তাড়াতাড়ি দাম মিটিয়ে দিলাম। ও অনেক আপত্তি করল, কিন্তু অনেক করে বুঝিয়ে রাজী করালাম…উপহার দেয়ার কথা বললাম। ভাবলাম,

“How a silly thing like this
can cry out
my long cherished longing?
I do, I do, I do…
love you for anything;
whatever be the price,
in this dear old world, you and I see.”

 

আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান। চট করেই পরিসমাপ্তি টেনে বসবেন না যেন আবার! আমি জানি আপনারা অভিজ্ঞজন; অনেকই জানেন। তবুও বলব, সব ঘটনা সবসময় চিরচেনা অভিজ্ঞতার ঋজু পথে হাঁটে না। আমার ক্ষেত্রেও তা হলো কিনা দেখুনই না?

এইসব ঘটনা কিংবা অঘটন এগুলোর কোনটার জন্যই আমরা হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না। বাইরে বেরিয়েই মেয়েটা গম্ভীর হয়ে গেলো-একটু বেশিরকমের গম্ভীর! পাশাপাশি হাঁটছি অথচ কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে মৌনতাকেই জায়গা করে দিলাম। অনেক সময় নীরবতা না-বলা কথাগুলোকে বাড়াবাড়ি রকমের অনায়াসে বলে ফেলতে পারে। হঠাত কী হলো জানি না…আচমকা থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ আমায় খুঁটিয়ে দেখে বলল, ‘যিয়াদ, কফি খেতে ইচ্ছে করছে, খাবে আমার সাথে?’ এই সময় আকাশটাও ভেঙ্গে নেমে পড়ল। আমিও কি ভেঙ্গে পড়ছিলাম না?

স্বচ্ছ কাচের ঢাউস জানালা দিয়ে ক্ষয়াটে বিষন্ন আলো ছোট্ট টেবলটাতে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। আর মুখোমুখি আমরা দু’জন। আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই আলো-আঁধারিতে মেইজিন আর আমি-স্বপ্ন দেখছি না তো? কী একটা অর্ডার করল আমার কানেই গেলো না! আমি আকাশের কান্না দেখছিলাম আর মনে যে কত কিছুর ঝড় বয়ে যাচ্ছে… গাঢ় স্বরে তন্ময়তা ভেঙ্গে গেলো, ‘ শোন, এদিকে তাকাও’

হ্যাঁ, কী বলছিলে? জিজ্ঞাসা করলাম।
আমাকে খুব কঠিন মনে হয়, তাই না?
কেন এ কথা বলছো?
আসলে কেউ আমাকে বুঝতে পারে না। সবাই কেবল বাইরেটাই দেখে। কাজ আর পড়াশুনার চাপে সবার সাথে মিশতে চাইলেও হয়ে ওঠে না। আর একটু ইনট্রোভার্ট…আমার আবেগ-অনুভূতি, ভাললাগাগুলো আমার মধ্যেই থেকে যায়…কেউই বোঝে না…শুধু কেউ কেউ ছাড়া…এই যেমন…

আমি জানি, বললাম।
জান? পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা। একটা কিছু মাপতে চাইছে।
কী একটা বলবো ভাবছিলাম অমনি ওয়েটার মেয়েটি এসে কথার তুফান মেল ছেড়ে দিলো। এবারেও কী বলল কিছুই কানে ঢুকল না। আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম।

চিন্তায় এলোমেলো থাকলে তোমাকে না বেশ লাগে! ও হেসে ফেললো।
তাই নাকি? ক’বে থেকে দেখলে? আমার চোখের তারায় কৌতুক! আমার আর কী কী ভালোলাগে?
বলব না। কানের কাছে চূর্ন চুলের গোছা পাকাতে পাকাতে চোখ নামিয়ে হাসতে থাকল। আমি আবারও বুকে ব্যথা অনুভব করলাম।
যিয়াদ, শোন…একটু থেমে থেকে বলল, ‘ তোমাকে তো ওর কথা বলাই হয় নি!’
কার কথা বলছো?
ম্যাথিঊ ওর নাম। বড় ভোলাভালা, একদম তোমার মত। যে বছর তুমি অন্য জায়গায় চলে গেলে, সে বছরেই…আমরা ভালো আছি, বিশ্বাস করো।

আমার ভেতরে এবার যেন সত্যিকারের ভাঙ্গনের শব্দ শুনতে পেলাম। বাইরে যে আকাশের কালো, তার থেকেও বেশি বিষাদের কালোয় ঢেকে গেলো আমার নিজস্ব আকাশ! বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম যেন। অর্থহীণ মনে হতে লাগলো সবকিছু। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলাম। অভিনয়ের মুখোশই যে আমার নিয়তি সেটা আবার বুঝলাম। হাসতে হাসতেই বললাম, ‘ এতো দারুন ব্যাপার, অভিনন্দন তোমাকে! একদিন পরিচয় করিয়ে দেবে তো?’ কফির কাপে কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে…কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সহসা ও বলল, ‘আমি, আমি খুব খারাপ মেয়ে। তোমাকে বোধহয় কষ্ট দিয়ে ফেললাম। বলো আমাকে ক্ষমা করে দেবে?’

আমি হেসে ফেললাম। ‘কেন ক্ষমা চাইছো? এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকের আপন একটা গন্ডী হয়েই যায় এবং সবারই নিজ নিজ পরিধি জানা থাকা উচিত। তোমরা ভালো থেকো।‘ এরপর আর কথা বাড়লো না। এই পরিবেশ অসহ্য লাগছে। বাড়ি ফেরা দরকার। তারপর গহীন নিঃশব্দে ডুব।

বাইরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ভেতরেও। ওর ছাতা নেই; ইতস্তত করছে, স্টেশানে যেতে হবে তো। একটানে আমার ছাতার নীচে নিয়ে এলাম। ঝুম বৃষ্টি…ঘন হয়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। এইতো অবাধ্য চুলের গোছা মাড়িয়ে দিচ্ছে আমার নাক। আহ, সুগন্ধ! একটা দেহজ কোমল উত্তাপ উচিত-অনুচিত্যের সংকীর্ণ পথ গলিয়ে আমাকে হয়তো শেষবারের মত পাগল করে দিতে চাইছে! হাত বাড়াতে গিয়েও নামিয়ে নিলাম। পথ মোটেই দীর্ঘ নয়; স্টেশান ঝুপ করে এসে গেলো।

বিদায় বেলা।

এই যে দাঁড়ান। আমার গল্পটা কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায় নি। ট্রেনে তুলে দিতে যাবো তখন মেইজিন একটা আজব কান্ড করে বসল; হঠাত জড়িয়ে ধরে…… থাক সেটা আপনারা নাইবা শুনলেন। একলাফে ট্রেনে উঠে গিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ বুদ্ধু কোথাকার! ম্যাথিউ বলতে কেউ নেই! আর মানুষ হলে না! আর লুকিয়ে লুকিয়ে স্টেশানে কাউকে দেখাটা মোটেই ভালো কথা নয়! হি হি হি’
যুগপৎ আনন্দ আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর হাসিটুকু মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বুকে ধরে রাখলাম। নক নক। মেসেজ এসেছে। ‘ লভ ইয়্যু মোর দ্যান আয় ক্যান সে…’ আর তক্ষুণি নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য হাত কামড়াতে ইচ্ছে হলো- ইস! মেয়েটা ঠিকই দেখেছিলো স্টেশানে কেমন হ্যাংলার মত তাকিয়ে থেকে থেকে স্থাণু হয়ে গেছিলাম! বুক থেকে আলগোছে একটা শ্বাস বেরিয়ে গেলো। এখন আপনারাই বলুন না তাতে দুঃখ, আনন্দ কিংবা স্বস্তি কোনটা ছিলো?

☼সমাপ্ত

:::স্টিলেটোস(Stilettos):::

চার বছর কি খুব বড় কোনো সময়? আবার নিশ্চয়ই তেমন ছোট সময়ও নয়! একই ছাদের নীচে একটা লোককে জানতে কত দিন লাগে? অরণি আসলেই এর উত্তর জানে না! কত দ্রুত সময়গুলি গড়িয়ে গেলো! অথচ এখনও ঠিক মন পেলো না সেজান -এর। কত কিছুই তো করে। কী খেতে ভালবাসে, কী পরে, কোথায় যেতে পছন্দ করে ইত্যাদি নানান ব্যাপার অরণির নখদর্পনে। কিন্তু তবুও সেজান ওর হয় না!
আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেলো বেড়াতে এসেছে মামাত বোনের বাসায়। এ ক’টা দিন একবারও নিজে থেকে ফোন করে নি সেজান । অরণিই যেচে ফোন করে খবর নিয়েছে। এই নিস্পৃহতার পেছনে যে অব্যক্ত চোরা গ্লাণিটা আছে, সেটা অরণি বুঝেও বুঝতে চায় না।
আনমনা হয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিলো অরণি। ভুলেই গেছিলো রাস্তার পাশে প্রকাণ্ড শপটায় উইণ্ডো শপিং করছিলো। বড় কোনো জুতোর শপ দেখলেই অরণি থেমে যায়। ঐ দেখাই সার। জানে কখনো কেনা হবে না। অত সাধ্য আছে নাকি তার? সেজান -এর টাকায় সে অবশ্য অবলীলায় কিনতে পারে, কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বোধহয় বলতে পারবে না। তাই কী আর করা, শুধু দেখেই যাও! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণি।
সব জুতোই যে ওর পছন্দ হয়, তা কিন্তু নয়। এক জোড়া স্টিলেটোস বহুদিন ধরে কিনবে কিনবে করেও কেনা হচ্ছে না। না, তার নিজের গরজে নয় – সত্যি বলতে গেলে সেজান -এর আগ্রহের জন্যই কিনবে। লোকটা স্টিলেটোস বড় পছন্দ করে। সোহানার পায়ে নাকি অদ্ভুত মানিয়ে যায়! হুম, সোহানা। নামটা মনে হতেই আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস টুপ করে ঝরে পড়ে।
সোহানা সেজান -এর অরণি পর্বের আগের কাহিনি। সব চুকেবুকে গেছিলো প্রায় বছর পাঁচেক আগে। এক তরফা সম্পর্কচ্ছেদ – সোহানার দিক থেকেই। বিয়ের আগেই সেজান ওকে সব জানিয়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কারণটা উদ্ধার করতে পারে নি। প্রত্যাখানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে যে রাগের মাথায় অরণির সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে সেজান, এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলো অরণি। কিন্তু করার খুব বেশি কিছু ছিলো না। মামার আশ্রয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হওয়া একটা মেয়ের বলার কি খুব বেশি কিছু থাকতে পারে?
বোঝাবুঝির আগেই একদিন প্রকাণ্ড যন্তরের পাখিটা ওদের নিয়ে আকাশে ডানা মেলে দিলো। গন্তব্যঃ বিভুঁই।

ভিন দেশে অরণি আতান্তরে পড়ে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হয় বাইরের শীতল প্রকৃতি যেন সম্পর্কের শীতলতার কাছে নস্যি! সেজান ঠিক রূঢ় শীতল ব্যবহার করে না ওর সাথে। কিন্তু উষ্ণতাও যে নেই, এটাও ধ্রুব সত্যি। আর মাঝে মাঝে সোহানা আসে। নানান কথায়, তুলনায়। ইচ্ছাকৃত কিনা, কে জানে? পায়ের সৌন্দর্য নিয়ে এক ধরণের অবসেশান আছে সেজান -এর। তাই সোহানার পায়ে স্টিলেটোস হিলের প্রশংসা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। ওরকম সুন্দর পা নাকি দেখাই যায় না! আরো কত কী? আফসোস, অবসেশান থাকা সত্ত্বেও অরণির পায়ের দিকে কখনোই সেভাবে দেখে নি সেজান। সে কি এতটাই ফেলনা? ইচ্ছে করে এক জোড়া স্টিলেটোস কিনে একদিন দেখিয়ে দেয়!

এক্সকিউজ মি প্লীজ, আপনি কি বিশেষ কিছু খুঁজছেন? কোনো সাহায্য করতে পারি?
ঘোর কেটে যায় অরণির। তাকিয়ে দেখে উজ্জ্বল চোখের একটা তরুণ শপ এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় স্যন্ডি ব্লণ্ড চুল। ওর তন্ময়তা দেখে নিশ্চয় খুব মজা পেয়েছে। ফিকফিক হাসছে।
‘না, না আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ!’ এড়িয়ে যেতে চায় অরণি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
হেল্প করাই আমাদের কাজ। আসুন, আপনাকে আরো কয়েকটা দেখাই। কত সাইজ আপনার? উম…৫? এদিকে আসুন, দেখাচ্ছি।
এমন আন্তরিকতায় ‘না’ বলাটা অশোভন দেখায়। অগত্যা অরণিকে যেতে হলো। এই ফাঁকে ব্যাজ থেকে সে নামটা পড়ে নিয়েছে – এইডেন।
এইডেন হরেক রকমের স্টিলেটোস দেখিয়ে চলেছে। সেদিকে তেমন মন নেই অরণির। শেষ ক’বে কে এভাবে তাকে এমন উষ্ণ আন্তরিকতা দেখিয়েছে, মনে করতে পারলো না। ব্লণ্ড ছেলেটা অবশ্যই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু তা বাদেও কিছু একটা অরণিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
কেউ কি কখনো আপনাকে বলেছে – কত সুন্দর এক জোড়া পা আছে আপনার! যে কোনো স্টিলেটোসই মানিয়ে যাবে…
অপ্রস্তুত অরণি চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করতে থাকে।
‘আমার একটু তাড়া আছে, তাছাড়া পার্সটাও বোধ হয় ফেলে এসেছি। পরে একবার আসবো, কেমন?’ হড়বড় করে বলে বেরিয়ে যায়।
‘স্যরি, আমি আপনাকে অপ্রস্তুত করতে চাই নি। ইয়্যু রিয়েলি হ্যভ আ ফাবিয়েলাস পেয়ার আভ ফিট!’ পেছন থেকে হেঁকে উঠে এইডেন।

এভাবেই শুরু। ক’দিন পর অরণি কেন যে আবার সেই শপটাতে গেলো, সে এক রহস্য বটে! কীসের টানে? উইণ্ডো শপিং, স্টিলেটোস নাকি ঐ ব্লণ্ড ছেলেটা? কোনটা যে ঠিক, ঠাহর হয় না! এমন ভাবনায় পায়ে পায়ে পেছনে এইডেন এসে হাজির হয়।
‘কী? আজকে নিশ্চয় পার্সটা নিয়ে এসেছেন, নাকি? কোন্‌টা নেবেন? আবার দেখাবো?’ সকৌতুকে জিজ্ঞেস করে এইডেন।
কাজের থেকে খুচরো কথাই হয় বেশি। জানাশোনা ডালপালা মেলতে থাকে সন্তর্পনে। কিন্তু এবারও জুতোটা কেনা হয় না অরণির। যাওয়ার সময় এইডেন জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার নামটাই তো জানা হলো না, মিস্‌?’
কীভাবে নিশ্চিত হলেন আমি মিস্‌ – মিসেস্‌ও তো হতে পারি।
হোয়াটেভা(র)…কী নাম তোমার?
কাল বলবো। হেসে ফেলে অরণি।
‘কাল আসবে?’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এইডেনের চোখ! কিন্তু অরণি কিছু বলে না। কী একটা আনন্দ দুই চোখের তারায় ঝিকিমিকি খেলতে থাকে।

দিনটার গায়ে শত বর্ণের প্রলেপ লেগে যায়। নদীর ধারে রাস্তাটা ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকে। ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যায়। নতুন করে জীবনটা কি আবার শুরু করা যায় না? দমকা হাওয়ার মত আকস্মিক এই চিন্তাটায় থমকে দাঁড়ায় অরণি। কেন এমন ভাবছে?

বেলা পড়ে এসেছে। শীতের এই বিকেলগুলোতে ঝুপ করে নেমে আসে আঁধার। রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিলো অচেনা কতগুলি পাখিকে। হটাত সেগুলি ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায়। বিষন্ন হয়ে যায় অরণি। সবারই ঘরে ফেরার তাড়া; শুধু তারই নেই! তার ঘর থেকেও হলো না কেন? নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা সর্বগ্রাসি ঢেউ উঠেও যেন মিলিয়ে যেতে বসেছে।

হঠাত মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। কে আবার, এই সময়ে? বিরক্তিভরে স্ক্রীনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সেজান ওকে ফোন করেছে? আশ্চর্য হলেও ফোনটা ধরে না। বেজে বেজে ভয়েস মেলে চলে গেলো। কানে লাগিয়ে শুনলোঃ একটা ভরাট কণ্ঠে শুধু দু’টি শব্দ – কোথায় তুমি? এতদিন পর শুধুই দু’টি শব্দ! আর কি কিছুই বলার নেই? কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে বড্ড প্রতারিত মনে হয়। কিন্তু দোষটা কাকে দেবে সে – ঠিক বুঝে উঠলো না!

সেজান বড় অবাক হয়ে যায়! অরণির মামাত বোনকে ফোন করে জেনে নিয়েছে সেই সকালে নাকি বেরিয়েছে। ফোনও ধরছে না। দু’সপ্তাহ হতে চললো সর্বশেষ কথা হয়েছে। সব সময় অরণিই খোঁজখবর রাখে। শুধু এবারই ব্যতিক্রম। অবজ্ঞার খুব গভীরে কোথায় যেন একটা উদ্বেগের বুদবুদ ভেসে ওঠে। কী হলো মেয়েটার? এই ভাবনাটার জন্য নিজের উপরই এক প্রকার চটে ওঠে সেজান।

সমস্যাটা বোধহয় আস্থার সংকট। বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মত সোহানার মুখ ফিরিয়ে নেয়া সেজানের বিশ্বাসের জায়গাটা একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। কাউকে আপন করে নিতে এখন তার বড্ড ভয় হয়। পেয়ে হারানোর ব্যথাটা সে বোঝে। তবুও একটা চেষ্টা সে একবার নিয়েছিলো। অরণিকে আসলে অপছন্দ করার কিছু নেই। চমৎকার মেয়ে; সাবলীল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু নিজের করে নিতে পারলো কোথায়? এতগুলি বছর বোধহয় বৃথাই গেলো। আসলে কি তাই?

বাসায় ফিরে অরণি কিছুই খেলো না। রুচি উবে গেছে। বিছানায় শুয়ে কেবল এপাশ-ওপাশ করতে থাকলো। দু’চোখে ঘুম নেই। বুকের ভেতর যেন একটা আজব ম্যাচ চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বী – সেজান আর এইডেন। কার পক্ষ যে নেবে, এটাই বুঝে উঠছে না অরণি। প্রচণ্ড টানাপোড়েনে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষটায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সিদ্ধান্ত অবশ্য নেয়া হয়ে যায়।

সকাল থেকেই একটা অদ্ভুত শূন্যতায় পেয়ে বসে সেজানকে। কী যেন একটা খোয়া গেছে – এরকম একটা ভাব। নিজের মনকে বোঝালোঃ আর পাঁচটা অভ্যাসের মত অরণির অস্তিত্বও এক রকম। যেন প্রিয় একটা আসবাব বেখেয়ালে হাতছাড়া হয়ে গেছে! এই ভাবনাটায় এক প্রকারের স্বস্তি অনুসন্ধান করে সেজান। কিন্তু প্রবোধের প্রচ্ছন্ন অসারতায় খুব গভীরে গিয়ে ঠিকই অলখে জব্দ হয়ে যায়!

দুপুর নাগাদ ভেতরে ভেতরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সেজান। মোটে তো ১৫০ মাইল! হাইওয়ে ধরে গেলে কত লাগবে? চলেই যাবে নাকি? হঠাত গিয়ে চমকে দিলে খুব কি ছেলেমানুষি হয়ে যাবে? চুলায় যাক সব দ্বিধা! সেজানের হাতে আলগোছে সি আর ভি –এর চাবিটা উঠে আসে।

শেষ বিকেলের ক্ষণজন্মা মধুর আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে অরণিকে। নদীর ধার ঘেঁষে রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশ ক’জোড়া কৌতূহলী চোখ কখনো আড়চোখে, কখনোবা সরাসরিই তাকিয়ে আছে। সেইসব চোখে নিখাদ মুগ্ধতার সাথে কড়কড়ে অসভ্যতা থাকলেও আজ কিছুই গায়ে মাখে না অরণি। আজ বড্ড আনন্দ হচ্ছে। হঠাত মনে হয় – প্রশংসাকারি চোখগুলি কি এক প্রকারের জীবন্ত আয়না নয়? বন্ধনের বদ্ধ জলে নিজের অপরূপ তরঙ্গটাই তো ভুলতে বসেছিলো!

জুতোর দোকানে গিয়ে জানতে পারলো এইডেন আজ আসে নি। আশ্চর্য! গতকাল তো বলেছিলো আজ আসবে… মনটাই খারাপ হয়ে যায়। শুধু তার সাথেই কেন এসব ঘটে? পেয়েও সব খোয়া যায়।

শীত আরো জেঁকে বসেছে। বাইরে বেরিয়েই জ্যাকেটের হুডটা তুলে দিলো। আনমনে পথের হলুদাভ ঝরা পাতাগুলো দেখতে দেখতে হাঁটছিলো। ঠিক যেন তার মতই বিবর্ণ! হঠাত দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়! কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখে স্যন্ডি বণ্ড চুলে ঢাকা উজ্জ্বল চোখে রাজ্যের দুষ্টুমি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এইডেন। তার হাত দু’টো অরণির সরু কোমর ঘিরে শক্ত আকর্ষনে ব্যস্ত!

অদূরে বিনা কারনেই(!) কারো ক’টা হার্টবিট মিস হয়ে যায়!

এই আকস্মিক চমকে অরণির ভালো লাগতে থাকলেও সে দ্রুত বিবেচনা ফিরে পায়। ঝট করে কিছুটা রূঢ়ভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁপাতে থাকে। এইডেনের চোখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাহনি। সে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে।

আ’ম স্যরি! কালচারাল ডিফরেন্সটা আমায় মাথায়ই আসে নি। কিছু মনে করো নি তো!
‘না, ঠিক আছে’ অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় অরণি।
‘আমরা কোথাও বসি যদি তোমার আপত্তি না থাকে?’ জিজ্ঞেস করে এইডেন।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
হেসে ফেলে অরণি। এইডেনও হাসে। পাশের একটা ক্যাফেতে দু’টো গরম কফি নিয়ে দু’জনে বসে পড়ে।
কী কথা হয়, কে জানে? তবে, মাঝে মাঝে বাঁধ ভাঙ্গা কিছু হাসি আর পরিবেশের প্রাঞ্জলতা বলে দেয় অনন্য কিছু সুন্দর সময় যাপনের কথা। কী আশ্চর্য অরণি এতো সুন্দর হাসতে পারে? কই কখনো তো খেয়াল করে নি! সেই হাসিটুকু কেন ওর নিজের নয় – এই ভাবনাটার প্রবল যন্ত্রণাকাতর ঈর্ষায় পুড়তে থাকে সেজান। এ এক নতুনতর অভিজ্ঞতা। সোহানার পর কেউ কখনো এমন প্রবল যন্ত্রণায় ফেলতে পারবে – এই কিছুক্ষণ আগেও যে ভাবতে পারে নি।

অরণি হাত বাড়িয়ে এইডেনের একটা হাত ধরে ফেলে। দু’জন খুব কাছাকাছি চলে আসে। এ কী চুম্বনও হয়ে যাবে নাকি? সেজান আর ভাবতে পারে না। মাথায় দপ করে একটা ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে ছেলেটাকে দুইটা বসিয়ে দেয়। কিন্তু আগুনটা যেমন ফট করে জ্বলে ওঠে, তেমনি অকস্মাৎ নিভে যায়। কোন অধিকারে করতে যাবে সেটা? এই চার বছরে উপেক্ষার গ্লাণি ছাড়া আর কী দিয়েছে সে অরণিকে? তার অপরাধের তো সীমা পরিসীমা নেই। নিজের ব্যর্থতার ঝাল মিটিয়েছে চমতকার মেয়েটির উপর। অথচ এটা কি ওর প্রাপ্য ছিলো?

ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যেতে থাকে সেজানের। অনেক চেষ্টা করেছে অরণি। কীসে মন পাওয়া যাবে সেজান –এর? সেজান বরাবরই এসব শীতলতার সাথে নিয়েছে। আত্মিক যোগসূত্রে বাঁধা পড়তে চায় নি ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায়। আহ্‌, কী নিদারুণ অন্যায়! এখন সেই মেয়েটি যদি মনের মত কাউকে খুঁজে নিতে চায়, তাতে কীভাবে দোষ দেখে! বরং সব দোষ নিজের – মেনে নেয় সেজান। তারপর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এঞ্জিনটা চালু করে। ফিরে যাবার পথ ধরে।

প্রবল বেগে মাথা নাড়াতে থাকে এইডেন। সেটা বোধগম্যতায় নাকি অবুঝ আব্দারের শোকে – ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু অরণির চোখ সেদিকে নেই। হঠাত ওর দৃষ্টি আটকে গেছে পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া সি আর ভি টার দিকে – কেমন যেন পরিচিত! দ্রুত লাইসেন্স প্লেটটা পড়ে দম আটকে যায়। এ তো ওদের – কীভাবে এখানে এলো? তার মানে সেজান কি…? আর ভাবতে পারে না অরণি। ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। অল্প ক’টা কথায় বিদায় নিয়ে পা বাড়ায়। সময় বেশি নেই!
‘একটু দাঁড়াও, এটা তোমার জন্য এনেছিলাম। প্লীজ, না বলবে না’ এইডেনের চোখে আর্তি।
কী এটা?
একটা ছোট্ট উপহার – এক জোড়া স্টিলেটোস। তোমার পছন্দ হবে। শুধু তোমার আর …… জন্য।

ফাঁকা জায়গাটা ফাঁকাই রেখেই দেয় এইডেন। যে যার মত বসিয়ে নেয় যেন। অরণি ক্ষণকালের জন্য চেয়ে থাকে। একটা নামহীন সম্পর্কের জন্য কেমন একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকে। স্টিলেটোস জোড়া শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। হিলগুলির সুচালো ডগা বুকের খাঁচায় গিয়ে বেঁধে যেন ওগুলো হিল নয়; একেকটা সত্যিকারের স্টিলেটোস ড্যাগার। দু’টো তীক্ষ্ণাগ্র ডগা যেন অরণির ঘটনাবিহীন জীবনকে এক লহমায় ঘটনাবহুল করে তোলে। কেউ দেখে না একটা সহজ চাওয়া কেমন দু’টো প্রাপ্তির বিপরীত ধারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতে থাকে… জীবনে চাওয়া-পাওয়াগুলো এতো জটিল হয় কেন?

ছোট গল্প: পুনর্ভব

প্রায় প্রতিদিনই তো রাত করে আমায় ফিরতে হয়। মধ্যরাতের শেষ বাসটিকে বিদায় জানিয়ে মিনিট পনেরোর পথ হাঁটছিলাম। জনবিরল রাস্তা; দু’এক জন পথচারি থাকেই তো। অথচ সেদিন কাউকে পেলাম না, আশ্চর্য! বাতিগুলোকে একটু ম্লান মনে হচ্ছে…কিন্তু তাই বা হয় কী করে? এবারে চোখটা দেখাতেই হবে আর কী ভেবে ভেবে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ মাটি ফুঁড়েই যেন একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। বুকটা অজানা কোনো একটা অস্থিরতা কাটিয়ে উঠে যেন স্বস্তি খুঁজতে চাইল। শীতের নিশুতি রাত; আপাদমস্তক গরম কাপড়ে মোড়া বলে ঠিক বুঝলাম না আমার কোনো প্রতিবেশি কিনা। আমি যেদিকে হাঁটছি ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে। বাহ্‌! ভালোই হলো ভাবলাম। তখনো জানতাম না কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

হাঁটতে হাঁটতেই দেখলাম আমার সঙ্গী পথচারিটি দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনছে। মনে হচ্ছে হাঁটার প্রতিযোগিতা বুঝি! আমিও কী মনে করে একটু গতি বাড়িয়ে দিলাম। চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম: তারও গতি বেড়েছে। এহে! এই রাতবিরেতে খেলতে চাও? ঠিক আছে, আমিও নাছোড়বান্দা। দ্রুত পা চালালাম…এখন প্রায় ছুটছি…সেও ছুটছে। তখনি ভুলটা করে ফেললাম-ডানে মোড়টা না নিয়ে সোজা যেদিকে পরিত্যক্ত একটা ইস্কুল আছে সেদিকে পা বাড়ালাম। মিনিট পাঁচেক ছোটার পর হুঁশ ফিরে এল-আমি এদিকে কেন? আজব! চারপাশে তাকাতেই গা হিম হয়ে গেলো। প্রায় বিশ গজ দূরে ‘সে’ ও দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক একি ভঙ্গি-আপাদ-মস্তক আমার কাপড়ে মোড়া, আমার চোখজোড়া যেন সেখানে বসানো, চশমাটাও আমারি…ঠান্ডার মধ্যেও একটা ঘামের বিন্দু শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে চাইছে। এ যে আমিই …শুধু তার মুখে লেগে থাকা একখানা ক্রুর হাসি ছাড়া। এমন আতান্তরে কখনো পড়িনি; পায়ের নীচে ক্ষয়াটে ধূসর মাঠ যেন দুলে উঠলো। চোখটা একটু বুজতেই যেন অতীতের কিছু দৃশ্য শাঁ শাঁ উড়ে গেল…এই একি মাঠ, ভয়ার্ত একটা মানুষের মুখ…ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ…অস্তিত্বের দখলদারিত্বে হেরে যেতে থাকা বিবর্ণ একটা সত্তা। আচমকা সব মনে পড়ে গেলো…অজানা থেকে এসেছিলাম…কৌতুহলে মানুষ হতে চেয়েছিলাম। অজান্তে শিকার করেছিলাম উদাসীন একটা মন কে। কে জানত তার বুকে এতটা কষ্ট ছিল! এ ক’টা দিন তাঁর মতই হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এতটা গভীর ক্ষত শুধু মানুষই বয়ে বেড়াতে পারে। বুঝতেই পারিনি ধীরে ধীরে পরাজিত হচ্ছিলাম! ঝুঁকে পড়া সেই আগুন্তকের ক্রুর হাসিটা হটাৎ কোমল হয়ে যায়! নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে ক্ষমা করে দেয় বুঝি। মানুষই বুঝি পারে এতটা দুর্বোধ্য হতে! এরপর আর কিছু মনে নেই আমার!

☼☼☼☼☼☼

ইস্কুলের মাঠে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম! বন্ধ হাতঘড়ির রেডিয়াম আলোয় তারিখটা দেখে আঁতকে উঠলাম! ইয়া আল্লাহ! ছয়মাস সাতদিন কোথা দিয়ে গেলো! কিছুই বুঝতে পারছি না। ধুলো ঝেড়ে দিক ঠিক করে হাঁটতে থাকলাম। একটা অন্য রকম বিষাদে মনটা ভরে আছে। কিন্তু কেন? মন বলছে সব জানি, কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না! আশ্চর্য!!

সমাপ্ত

♥মিলার মুক্তি এবং এক অচেনা যুবক♥

১.

মিলার মনটা বেশ খারাপ। শিহাব গত রাতেও ফেরে নি। এখন এরকম প্রায়ই হচ্ছে। হুট করে ফোন করে বলে কাজে আটকে গেছে। শিহাবকে চাকরি সূত্রে মাঝে মাঝেই এই শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতেও কি চাকরি থাকে? জিজ্ঞেস করলেই আগডুম বাগডুম একটা বুঝিয়ে দেয়। মিলা কি সেসব বোঝে না? সে সবই বোঝে। অনাদর কিংবা উপেক্ষাটা চাপা থাকছে না ইদানীং। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। কী লাভ?
চমৎকার সাজানো বেডরুমের শূন্য কিং সাইজ বিছানাটা কি একধরণের নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নয়? মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রে একা শুয়ে আছে! আজকের সকালটাও কেমন কেমন যেন। থমথমে মুখের মেঘেদের নিয়ে গোপন কোনো অভিমানে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। জানালা দিয়ে টুকরো বিষন্ন আকাশটা দেখে এসবই ভাবছিলো মিলা। এই দু’বছরে বেডখানা কেবল উপহাসই করে গেলো!
বেলা একটু একটু ধীর পায়ে বাড়ছে। ছুটির দিনে উঠতে ইচ্ছে করছে না। উঠে করবেইটা কী? শিহাব নেই তো নাস্তা করবে কার জন্য? নিজের জন্য কোনোদিনই ভাবনা থাকে না মিলার। যাহোক একটা কিছুতে বরাবরই সন্তুষ্ট থেকে এসেছে। নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কখনো উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেনি কেউ তাকে। তাই যখন শিহাবের সাথে সম্বন্ধটা এলো, রাজী হয়ে গেলো এক রকম। যোগ্য ছেলে। মাল্টি ন্যাশনালে ভালো চাকরি করে। যদিও বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশিই ছিলো। কিন্তু কেউ গা করলো না! তবে গোপনে কি বুকটা ভিজেছে একটু? রঞ্জুকে কি ভালোবেসেছিলো ও? তবে সেও তো এক তরফাই ছিলো। ঐ যে নিজের কোনো ব্যাপারই গা করে না। ঐটিও এক প্রকারের একটা অপ্রকাশ্য গল্পের মত হয়ে থাকলো!
এইসব গভীর ভাবনায় কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো মিলা। সম্বিৎ ফিরে পেলো ফোনের শব্দে। আলগোছে তুলে নিয়েছিলো তাই খেয়াল করে নি নাম্বারটা।

হ্যালো? কে বলছেন?
অলস ঝিমঝিমে গলায় শুধায় মিলা। ওপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো। বার কয়েক জিজ্ঞেস করেই কেটে দিলো। দেখতেও ইচ্ছে করলো কে করেছে। মরুক সব! আবার ভাবনাতে ডুবে যাবে অমনি আবার বেজে উঠলো। এবার নাম্বারটা দেখলো। রাগে গা জ্বলে গেলো। আবার সেই লোকটা…
ফোনটা বেজেই চলেছে। বাজতে বাজতে এক সময় থেমেই গেলো। ইচ্ছে করলেই মিউট করে রাখতে পারে। কিন্তু আজ কী যে হয়েছে… কেমন যেন উপেক্ষা ভাব সব কিছুতে। ফোনটা খানিক বিরতি নিয়ে আবার বেজে উঠলো। কী সুন্দর একটা রিংটোন সেট করেছিলো – বৃষ্টির একটানা ধারাপাতের শব্দ! সেটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। আবার কিছু বিরতিতে বেজে উঠলো। প্যাটার্নটা পরিচিত হয়ে গেছে। এ সে-ই হবে। আর কেউ নয়! আচ্ছা ছ্যাঁচোড় তো। না ধরা পর্যন্ত জ্বালাতেই থাকবে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে। কীভাবে নাম্বার যোগাড় করেছে, কে জানে? খুব একটা কথা বলে না। শুধু জিজ্ঞেস করে – ভালো আছেন? আর একটা গুড়গুড়ে হাসি। ব্যস এটুকুই। কখনোই জবাব দেয় না মিলা। এই সামান্য বিষয়টাকে পাত্তা দেবে না বলে ঠিক করেছিলো। তাই কাউকে জানায় নি। শিহাবকেও না। এ কি বলার মত কিছু? কিংবা হয়তোবা কিছু একটা কি আছে? আজকে হঠাত করে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। ঐ আবার বাজছে।
ফোনটা ধরলো মিলা। রাগত স্বরে – কেন জ্বালান আপনি? কথাও তো একটা বলেন না! শুধু জিজ্ঞেস করেন ভালো আছি কিনা! কী চান আপনি? ভালো নেই, আমি ভালো নেই! খুশি? গলা ধরে আসে মিলার।
ওপাশে এই প্রথম বারের মত কণ্ঠটা চিরাচরিত গৎবাঁধা প্রশ্নটা করলো না। হাসলোও না। একটু যেন বিচলিত! গমগমে ভরাট কণ্ঠে একটু কেশে – ভালো নেই? কেন?
মিলা ঝেঁঝে উঠে – সেটা আপনাকে কেন বলবো?
বলবেন না? তাহলে বলতে গেলেন কেন ভালো নেই?
আমার যা ইচ্ছা তা-ই করবো, আপনি কৈফিয়ত চাওয়ার কে, শুনি?
আমি কেউ না।
ঠিক, আপনি কেউ না। দয়া করে আর জ্বালাবেন না। রাখছি।
না, রাখবেন না, প্লীজ।
কেন রাখবো না?
কারণ আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন। একটা খুক করে হাসির শব্দ আসে। রাগ বাড়তে থাকে মিলার।
আপনি অন্তর্যামি, তাই না? আমাকে না চিনেই সব বুঝে ফেললেন।
চিনি না, কে বললো? আলবৎ চিনি।
চেনেন, আশ্চর্য! আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না। মিলার কন্ঠে খানিকটা উষ্মা।
কথা বলতে থাকেন। বলতে বলতেই চিনে যাবেন।
আমার অত চেনাজানায় কাজ নেই। বিরক্তিকর একটা! বলেই খুট করে কেটে দেয় মিলা।

২.

মনটা কি একটু খারাপ হয়ে গেলো? কে এই লোকটা? ওভাবে অভদ্রের মত না রেখে দিলেও তো চলতো। খারাপ তো কিছু বলে নি। জানতে চেয়েছে ভালো আছি কিনা। আশ্চর্যের ব্যাপার, কতদিন পর কেউ একজন সত্যিকারের উদ্বেগে জানতে চেয়েছে ভালো থাকা না থাকার কথা! প্রকৃত আবেগগুলো বুকের গভীরে কখনো ধোঁয়াশা হয়ে থাকে না – ঠিকই পদচ্ছাপ রেখে যায়। মিলা বেশ বুঝতে পারে ঐ জানতে চাওয়াটা কতখানি খাঁটি! উহ, কিছু ভালো লাগছে না। আজকের সকালটাই বড্ড গোলমেলে ঠেকছে!
ভাবনার জাল কাটিয়ে আবার সরব হয়ে ওঠে ফোনটা।
মিলার সাঁড়াশি আক্রমণ – আপনি এত নির্লজ্জ কেন? এভয়েড কথাটি কি আপনার ডিকশনারিতে নেই? না থাকলে এন্ট্রি করে নিন।
ও প্রান্তের কন্ঠটি দরাজ হেসে ওঠে – আমার মনে হচ্ছে না আপনি আমাকে এভয়েড করতে চাইছেন। তারপর সেই বুক ওলটপালট করা নরম কণ্ঠে – বললেন না, মন খারাপ কেন?
কী থেকে কী হয়ে যায় মিলার। ধরা গলাটায় এখন পষ্ট একটা চাপা ফোঁপানির শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো। শ্রোতার বিচলতা আরো বাড়ে।
জানেন, ও গতকালও বাড়ি ফেরে নি! এরকম হয়েই চলেছে। বাকীটুকু উদ্গত কান্নায় বলতেই পারে না।
কে বাড়ি ফেরে নি, শিহাব সাহেব? ফোনের রহস্যমানব আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করে।
আবার কে হবে? শিহাব এখন ছুটির দিনেও বাড়ি ফিরছে না। জানেন, আমি আর পারছি না। ও আমাকে ভালোবাসে না। মনে হয় কোনোদিনও বাসে নি!
একটা প্রায় অপরিচিত মানুষের কাছে কীভাবে অকপটে নিজের গোপন দুঃখের কথাগুলি অনায়াসে বলতে পারলো? মিলা বড় লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়লো। তখনি ব্যাপারটা মাথায় এলো।
আচ্ছা, আপনি শিহাবের নাম জানলেন কী করে? তার মানে ওর পরিচিত কেউ?
অপর প্রান্তে হাসির শব্দ – কী ছিঁচকাঁদুনে, এখন মাথা খুলছে নাকি? হা হা হা। পরিচিত হলেই জানবে। আর কোনোভাবে জানতে নেই? আমি তো আপনার নাম-ঠিকানাও জানি।
জানেন? ওঃ, কীসব বলছি! সব আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছেন দেখি!
মিলা!
আপনি কী চান, পরিষ্কার করে বলেন তো? খালি খালি হেঁয়ালি করেন। কী নাম আপনার? থাকেন কোথায়? খালি একটা কথাই ভাঙ্গা রেকর্ডের মত বলেন – ভালো আছেন? কী লাভ আপনার আমি ভালো আছি কিনা জেনে?
লাভ আছে, সে আপনি বুঝবেন না। ভালোবেসেছেন কখনো?
মিলার দম খানিকটা আটকে যায়। সত্যিই তো…সে ভালোবেসেছে কখনো? রঞ্জুর অগোছালো চুলের প্রায় বিস্মৃত মুখটা ভেসে ওঠে। একতরফা বেদনা। তবুও ভালোবাসা তো। কিন্তু নিজেকে বঞ্চিত করে সে সম্ভাবনার গলা সে তো নিজ হাতেই টিপে দিয়েছে। নিজেকে বড় প্রতারিত মনে হতে থাকে। কেন নিজেকে একটুকু পাত্তাও দিলো না এত কাল?
মিলা যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
কী, জবাব দেবেন না? ওপাশের নাছোড়বান্দা তাড়া দেয়।
ঘোর ভাঙ্গে মিলার – কী বলছিলেন যেন?
বলছিলাম, ভালো বেসেছেন কখনো…
সে আপনাকে কেন বলবো?
আবার সেই কথা! এই ছ’মাসে আমরা কি একটুও কাছে আসি নি? কাছের মানুষ হতে আর কী কী লাগে, মিলা?
সে আমি জানি না। তবে ভালো করেই বুঝছি, আপনাকে প্রশ্রয় দেয়া আমার মোটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি বিবাহিতা.. এটা ঠিক নয়, মিস্টার এক্স…
অপরপ্রান্তে একটা সরল প্রাঞ্জল হাসি ভেসে আসে। সাথে একটু খুনসুটির ভাব।
ভয় পাচ্ছেন? প্রেম প্রেম মনে হচ্ছে? হা হা হা
অকারণ একটা লজ্জা পেয়ে যায় মিলা। আপনি তো ভারী ঠোঁটকাটা! কী সব যা-তা বলছেন?
যা-তা বলছি? আমার তো মনে হচ্ছে আপনার গাল দু’টো লাল হয়ে গেছে। গালের টোলটায়…
থাক, থাক অত বর্ণনায় কাজ নেই! ফোনে শব্দ শুনেই সব বুঝে ফেললেন। আপনি তো রীতিমত ফ্লার্ট করছেন!!
এতক্ষণে বুঝলেন? করলে ক্ষতি কী? বুকে হাত দিয়ে বলেন তো ভালোলাগছে না?
আমার বয়েই গেছে! খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই…অসভ্য কোথাকার!
আপনার কণ্ঠটা যে কত মিষ্টি, সে কি জানেন? বলতে গেলে সেই মধু শুনতেই তো হ্যাংলার মত খালি ডায়াল করি। না ধরা পর্যন্ত তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকি…
নাহ, আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। কোথা থেকে কোথা যে চলে যাবেন। বেশ বিপজ্জনক লোক তো আপনি!
একটা কথা বলি, শুনবেন? গাঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করে ভরাট কণ্ঠ।
শুনছিই তো। বলেন…
ওপাশে খানিক নিস্তব্ধতা। একটা টান টান উত্তেজনার তির এসে যেন সময়ের ধনুকে আপনি জুড়ে যায়। তিরটা একটা কিছু বলবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। কিন্তু অতি সর্বনাশাও যেন চূড়ান্ত ক্ষণটির আগে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে যায়। ভাষা হারিয়ে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে! শেষমেষ অপরিচিতের সেই ব্যাকুলতার কথাগুলো বলা হয়ে উঠে না। সুশীল সংকোচ!!
কী একটা বলতে যাবে অমনি কী করে জানি কিছু একটা বুঝে ফেলে মিলা। বলে – না, না থাক। কাজ নেই আর শুনে।
আহা, শুনেই দেখেন না? ভালোও তো লাগতে পারে।
না, না শুনবো না। এই ফোন সরিয়ে নিলাম।
অপরিচিত হাসতে থাকেন। আশ্চর্য মিলাও হাসতে থাকে। মনোভারের মেঘ কি কাটতে থাকে একটু একটু করে? মনের আকাশ ফর্সা হতে থাকে খুব ধীরে। সাথে জানালার বাইরে থমথমে আকাশটাও। মিলা দেখে মেঘ সরে গিয়ে নরম রোদ্দুর ঝিকিয়ে উঠছে। আচমকা বড় ভালো লাগতে থাকে।
আসেন, আজকে আপনাকে বেড়িয়ে আনি? কেমন হাসছে চারদিক, দেখেছেন?
মিলা কিছু না ভেবেই মুখ ফস্কে শিশুর সারল্যে বলে ফেলে – সত্যিই আসবেন?
পরক্ষণেই বিবেচনা ফিরে পায় যেন। না, না থাক। কিছু মনে করবেন না। সেটা ঠিক সংগত হবে না।
সে আমি বুঝলাম না আপাতত! আমি কিন্তু সত্যিই আপনার জন্য অপেক্ষা করবো… আসবেন মিলা?
না, না। সে হয় না। মিলা ক্ষীণস্বরে আপত্তি জানায়। তাতে অস্বীকার থেকে স্বীকারের পাল্লাই যেন হালকা একটু বেশি ভারী হয়ে থাকে। ওদিকের শ্রোতা ঠিকানা দিয়ে দেয়। একটা পার্ক। বেশি দূরে নয়। মিলাদের বাড়ি থেকে কাছেই। মিলা শুনবো না শুনবো করেও ঠিকই মনে রাখে। মন বড় আশ্চর্যের বস্তু!
ফোনটা একটা দুর্দম প্রতীক্ষার জোরালো প্রতিশ্রুতিতে কেটে যায়।

৩.

মিলা উঠে পড়ে। কি একটা তাড়া যেন বহুদিন বাদে ওকে নাড়া দেয়। বাথটাবের ঈষদুষ্ণ জলে ২৬ বসন্তের লতানো শরীরটা আলতো ডুবিয়ে রাখে। একটা অদ্ভুত পুলক গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেকে নিয়ে ঠিক ক’বে এরকম ভেবেছিলো, মনে করতে পারলো না। আচ্ছা, সে কি যাবে নাকি? বড় চঞ্চল লাগে।
আবার এ-ও মনে হয়ঃ এই শিহাবের সাথে আরোপিত বন্ধনে সে কী পেয়েছে? শিহাব কেন যে ওকে ঘরে তুলেছে, এ এক আশ্চর্য বটে! বিগত দু’বছরে শিহাবের সাথে কোনো ধরণের এটাচমেন্টই গড়ে উঠলো না। শিহাব কোথায় রাত কাটায়, সেটা আঁচ করতে পারে মিলা। কেন এখন ছুটির দিনগুলোতেও ফিরছে না, এটা বের করাও কঠিন কিছু না। পুরোনো প্রেম ভোলা সহজ নয়। শিহাব ভুলতে পারে নাই। সবাই সব জানে। তবুও শিহাব ফোন করে জানায়। এই আঘাত দেয়ার মধ্যে সুখ পাবার মানসিকতাটা দেখে ঘৃণায় তেতে ওঠে মিলা।
মাঝে মাঝে বড্ড হতাশ লাগে। আজীবন নিজের প্রতি উদাসীন থেকে কী পেলো? অবিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী? টানহীন, ভালোবাসাহীন দাম্পত্য? একটা অনাদরের পোকায় খাওয়া তারে ঝুলছে ঘরের সুখস্বপ্ন! অথচ মিলার এটা কি প্রাপ্য ছিলো? সে তো আর দশটা মেয়ের মত একটা ঘরই বাঁধতে চেয়েছিলো। সেটা কি খুব বেশি চাওয়া ছিলো? আর ভাবতে পারে না মিলা। টাবের ফেনিল জলে নীরবে মিশতে থাকে অভিমানের অশ্রুজল। বুকের ভেতর জমে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।
অনেকদিন বাদে বড় যত্ন নিয়ে সাজছে মিলা। একটা লালপেঁড়ে শাড়ি মুগ্ধ বিস্ময়ে আপ্লুত নদীর মত ছুঁয়ে গেলো মিলার অঢেল সৌষ্ঠব। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। অসামান্য স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি বাঁক ভাঁজ। আর একটা উপচানো প্রতীক্ষা… কার জন্য? কার জন্য আবার? নিজেই নিজেকে ধ্মকে ওঠে। আচ্ছা, কেমন হবে মানুষটা? যদি হতচ্ছাড়া দেখতে হয়ে থাকে? হলে হবে… সে তো কায়াহীন সত্তাটাকেই কাছে টেনেছে… বাকী ওসবে কী যায় আসে? তবুও এক নিষিদ্ধ আনন্দের মত উত্তেজনায় বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজতে থাকে চিবুকের খাঁজ, কপালের গুচ্ছ চুল।
স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে বেরোতে যাবে অমনি বেমক্কা একটা কল পেলো। না দেখে ধরেই জিজ্ঞেস করে – কে? আসছি, বেশিক্ষণ লাগবে না। অপেক্ষা করবেন কিন্তু! যেন নিশ্চিত সেই অচেনা যুবকেই করেছে!
কোথায় যাচ্ছো? বড় অবাক হয়ে যায় শিহাব।
থতমত খেলেও সামলে গেলো মিলা। বলে – ও, তুমি?
কাকে ভেবেছিলে? নাগর-টাগর জুটিয়ে ফেললে নাকি?
ভদ্র ভাষায় কথা বলো, শিহাব। সে শুধু তোমারই জায়গা তা-ই ভেবেছো, না?
মানে কী? স্পষ্ট করে বলো কোথায় যাচ্ছো?
তবে শোনো, একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তোমার মত শাক দিয়ে মাছ ঢাকছি না আমি। আমি ক্লান্ত, শিহাব। আর পারছি না। আমি মুক্তি চাই! হয়তো তুমিও চাও…
কথাগুলো অসত্য নয়। নরম মনের একটা মেয়ের থেকে কঠিন এই কথাগুলো শুনেও কিছু বলতে পারলো না। দোষ তো তারও কম নয়! এ তো হবারই ছিলো! লাইনটা আলগোছে কেটে গেলো।

রোদ চড়েছে বেশ। পার্কের গাছগুলো সবুজ পাতার নবযৌবন নিয়ে গর্বিত গ্রীবায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দৌঁড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, বাচ্চাকাচ্চার একটা দল হল্লা করছে পাশেই। রেশমি লোমে ঢাকা একটা কুকুর হাতে এক বৃদ্ধ আনমনে চলছিলো। মিলাকে দেখে একটা চোখ টিপে দিলো! কী অসভ্য!
এই রকম মানুষের মেলায় কী করে চিনবে সেই মানুষটাকে? সেই অতি অচেনার তবুও যেন কতকালের চেনা মানুষটাকে? আচ্ছা, ভালোবাসতে কত সময় লাগে? একটা সেইরকম পলই কি যথেষ্ট নয়? অদ্ভুত সেই সময়ে ততোধিক অদ্ভুত প্রতিবোধনের আলো এসে পড়লে যখন বুকের অস্বীকারি উদাসীন তারগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেতে থাকে, তখনই প্রেম লাজুক আত্মপ্রকাশ করে। ভাবতে ভাবতেই এলোমেলো হাঁটতে থাকে মিলা। আজ বড় ভারহীন লাগতে থাকে। কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? কীভাবে? যদি খুঁজে না পায়? বুকটা ঢিবঢিব করতে থাকে। যদি সে কথা না রাখে। শুধু ফোনে ফোনেই এতদূর! হঠকারিতা কি হয়ে গেলো?
হলে হবে। হঠাত সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা শক্তি যেন ভেতরে ভেতরে টের পায়… নিজেকে নিয়ে ভাবে নি এতকাল। নিজেকে একটুও ভালোবাসে নি। সময় দেয় নি আজন্মের বঞ্চিত সেই দুঃখি মেয়েটাকে। মনে হচ্ছে আজ সেই সময় এসেছে। বেশি ভাববার কী আছে? আজ কিছুতেই খোলসে ঢুকে যাবে না!
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। এদিকে ওদিকে উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে এলো না। একটা ঘন্টা বেশি পেরিয়ে গেলো। আচ্ছা, হাতঘড়িটা ঠিক চলছে তো! নাহ, ঠিকই আছে তো! কাউকে কি জিজ্ঞেস করবে সময়টা? এই অধীরতাই কি প্রেম? প্রেম শব্দটা নিজের মনে আউড়ে হঠাত আরক্ত হয়ে যায়। কেমন স্বপ্নীল মনে হতে থাকে সবকিছু! এই কোলাহল, পুঁচকেদের ঝগড়া, বুড়োর চোখটিপি – সব, সব ভালোলাগে। বেভুল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখনি কে একটা এসে মিলার আঙ্গুল ধরে টান দিলো।
সম্বিৎ ফিরে দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে একহাতে একটা গাঢ় লাল গোলাপ আর অন্য হাতে কাউকে দেখিয়ে দিচ্ছে। মিলা খুব মিষ্টি হেসে মেয়েটার গালদুটো নেড়ে দেয়। তারপর…তারপর খুব সন্তর্পনে, সেই ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঢিবঢিবানিটা নিয়ে বাচ্চাটির দেখিয়ে দেয়া দিকে পূর্ণচোখ মেলে চাইলো।
অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহি এক যুবক। ঈষৎ অবিন্যস্ত চুল। চোখে ভারী চশমা। আর মুখে লেগে আছে ভারী একটা দুষ্টু দুষ্টু হাসি। মিলার বুকটা একটা অসহ্য ভালোলাগায় টনটন করে ওঠে। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে একে অপরের দিকে। মোটে তো অল্প একটুক পথ। তবু যেন ফুরাতে চায় না। মিলাও চায় না। এত সুন্দর পথচলা যে ওর জীবনে আর আসে নি! আর কখনো আসে নি!
অচেনা যুবক কাছে এসেই ভরাট কন্ঠে বলে ওঠে – ভালো আছো, মিলা!
অস্ফুটে ভালো বলেই চোখ নামিয়ে নেয় মিলা। নত মুখের সেই অনন্য ভঙ্গিমায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে যুবক। প্রেম বোধহয় সর্বকালের আশ্চর্যের একটা বস্তু – কোনো বাঁধাই মানে না!

☼সমাপ্ত☼