নীরব অভিমান

চোখ ভরে আসে তপ্ত জলে,

কার উপর কীসের অভিমানে

বুকের জমিনে আহত শ্রাবণ নামে?

কী দিই জবাব যদি কেউ শুধায়?

জানা নেই, কিছু যে জানা নেই

কেন কাঁদে এই মন ব্যাকুল নিরুপায়।

দৃষ্টি যে তার শূন্য মলিন উদাসে

বুক ভাঙে পাঁজরের সস্তা দামে!

কে রোধে কণ্ঠ সারাবেলা

এই বিষন্ন আকুলি হুতাশে?

চোখ ভিজে যায় নোনা সন্তাপে

অমোঘের মেঘে জ্বলে

না পারার নি:স্ব প্রখর দহন।

কে হাসে যা কিছু ঘটেছে ভালো

তার সবটুকু আমূল খুইয়ে,

সর্বহারার উথল অভিমানে?

তাই নীরবতা, তোমায় চেয়েছি কাছে।

তুমি যে আজ আমার

বড়োই একান্ত আপন!

ফ্লার্টিং

– আপনার নামটা যেন কী?

নাম তো আমি বলিইনি!

– বলেননি! এখন তবে বলেন।

চাইলেই সব হয়, তাই বুঝি ভাবেন?

– নামই জানতে চেয়েছি, ঠিকুজি না!

বললেই সব উগরে দেবো, তাই না?

– আপনাকে চিনি না, ঝগড়া আমি চাই না

ওমা, কোথায় ঝগড়া? এ তো বাস্তবতা!

– আপনার দেখছি বড্ড বেশি দেমাগ!

সবারই তাই থাকে হলে খানিকটা সজাগ।

– হার মানছি, কেন মিছে লড়ে মরছি?

কে চেয়েছে? দিন না লড়াইয়ে যতি!

– আচ্ছা, এখন তবে নামটা পেতে পারি?

ও বাবা, কীভাবে? পরিচয় হলো নাকি?

– সেকি! হয়নি? এই তো আছি পাশাপাশি দিব্যি।

আপনি বড্ড গায়েপড়া, এভাবে কেউ বলে কি?

– আহা, নামই শুধু জানতে চেয়েছি, অন্যকিছু চাইনি!

এভাবেই সবে বলে, ভাজা মাছটি যেন উল্টোয়নি!

– আপনি তো দেখি অসাধারণ পেঁচুক!

কেউ জানি কলিকালের সরল ভাবুক!

– উফ! পেরে ওঠাই দায়, দস্যি মেয়ে বাবা!

এবার তবে থামি, কথা না বাড়ুক, টাটা।

– কিন্তু এ লগ্ন প্রেমের আবিরে মগ্ন, যাবে বৃথা?

ওমা, কবি নাকি? পালিয়ে বাঁচি, নেই যে আশা!

– অনেক হয়েছে, এবার নাহয় একটু মিল করি?

কী চাইছেন, তাই তো জানিনা, কীসে হবে কী?

– নামটা যেন কী? দুত্তরি ছাই, তলই না পাই!

নাম কটকটি। চলবে? নইলে আর না এগোই।

– হা হা হা, তবে ছলনা নয়, সত্যি?

হি হি হি, তাহলে আর বলছি কী!

দশটি অনুকবিতা

১. 

মন্দির জ্বলে, মসজিদ ভাঙে

লোভী হায়েনারা হাসে।

বিশ্বাস পুড়ে, শেকড় ছিঁড়ে

কে দেখে মানবতা কাঁদে?

২.

আমি তোমাদের কেউ নই

কেউ নও তোমরা আমার।

তবুও থাকি পাশাপাশি

যেন চিনি জন্ম-জন্মান্তর!

৩.

দিনগুলি গড়াচ্ছে দ্রুত

যেন বল্গাহীন ত্বরণ

নুয়ে যাচ্ছি, ক্ষয়ে যাচ্ছি

বিদ্রুপে অমোঘ মন্দন!

৪.

নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবো

কী ভয়ানক মূঢ়তা!

তুমি যে কিছুই নও

জানো কি পরম সত্যটা?

৫.

ভিড়ের মাঝেও একা আমি

তুমিহীন শূন্যতা

কোলাহলেও নৈশব্দ ছুঁই

বুঝ কি এই যন্ত্রণা?

৬.

ভালোবাসতেই হবে এমনটা নয়;

অনাদরে রেখো না।

আড়ম্বরের চুম্বন নাইবা পেলাম

শুধু অনীহা পুষো না!

৭.

হাসিমুখ তোমাদের বিস্মিত করে

সুখ তোমরা পাও না।

চোখের তারায় নিখাদ দুর্বোধ্যতা

দুখও তোমরা জানো না।

৮.

জীবনের কোনো বিশেষ মানে নেই

এবেলা স্বীকার করে নাও।

যাপনের কোনো দৃঢ় কারণও নেই

অহেতুক মোহপাশে যতি দাও।

৯.

মুখে বলো ভাই ভাই

ভেতরে ঘৃণার সীমা নাই।

মনে নাকি কিছু নাই

অথচ নিনাদে নিকুচিটাই!

১০.

যার যার আমিটাই বড়ো

আর সব ফাঁকা

অহংভারে পিষ্ট থাকো

চক্ষু দুটি বাঁধা।

এমনি ভালোবেসো!

বুকেতে এই ভালোবাসা এমনি রাখো জমিয়ে
আমায় চেয়ে যত চাওয়া এমনি ঢালো বিরহে।
তোমায় আমি পোড়াই সখি নিত্য দুখের অনলে
পারি না যে, কী ভীষণ জ্বালা সে, একটুও জুড়োতে।
আমায় তবে শাস্তি দিয়ো, আঘাতে আঘাতে করো বিদ্ধ
এই পাঁজরে সব সয়ে যাব, তবু প্রেম হোক অনিরুদ্ধ!
বুকেতে এই চাওয়া, পাগলা হাওয়া, এমনি ঝড়ে টেনে নিয়ো,
এই আদরে নীরব অভিমানে একটা অবুঝ আঙ্গুল রাখতে দিয়ো!

পাওয়া না-পাওয়া

শুনছ, কিছু অপ্রাপ্তি থাকে তো থাক
সব পাওয়ার জাদুকরি এ যুগে
কিছু না-পাওয়া অহরহ জমে যাক।
সবটা দেখা না হোক, থাকুক কিছু কল্পনা
নিত্য রচুক অদেখার জ্বালা-জানালা
দাঁড়িয়ে থেক একাকী – প্রতীক্ষায়,
এঁকো নিবিড় রঙিন আলপনা।

শত কথামালার অযাচ্য ভিড়
মুখ লুকায় খুব চাওয়ার সেই শব্দনীড়।
তবু জেনো, কিছু কথা না-বলাই থাক
অনুক্ত থাক হৃদয়ের গভীরতম ভাবনা।
বোবা ভাষায় বুঝে নিও সেসব
বুকে নিও কাছে না পাবার সব যাতনা।

কিছু রহস্য থাকে তো থাক যেন জমাট নিশুতির গল্প
সবটা জানতে চাই না, তুমিও চেয়ো না
কে না জানে সব জানায় উচ্ছ্বাস চিরন্তনী অল্প!
শুনছ, সব মিছের এই যুগে একটাই ধ্রুব সত্য
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি
তুমি আমার, রবে যুগে যুগে
বুকে রেখ এই নিত্যতার আদিগন্ত।

ভালোবাসি প্রিয়!

আমার ভালোও তো লাগে
এই দুকুল ভাসা হৃদ-পিঞ্জরে।
নিরেট এই ভালোবাসাহীনতায়
কেউ তো আমার জন্য ভাবে।
হায়, জীবনটাই যে গেছিল খরচে
বড্ড অনাদরে, ভালোবাসার অনটনে।

এই মনই কেবল জানে কখনও চাইনি কিছু
মুখ ফুটে বলিনি কভু – ভালোবাসি প্রিয়!
শুধুই মনোমেঘে নিরল বরিষণ
কেন কেউ বুঝেনি, বুঝতে চায়নি
আমার মগন গহন নীরব আবেদন!
বুঝতে দিইনি, কোথায় রেখেছি
যত অবুঝ আদুরে চাওয়ার ব্যথা।
অতঃপর সে এলো, ভালোবাসল, রাঙালো
বর্ণহীন আমার জীবনগাথা।
বলল, রাখবে এ বুকে
তোমার সর্বহারা নিঃস্ব অভিমানী মাথাটা?

আমার ভালো যে লাগে
এই স্বেচ্ছাবন্দীত্ব,
এই দখলপ্রবণ আদুরে উপনিবেশ
কেউ তো আমায় বুকে তুলে নিয়েছে!
যত্নে শুধিয়েছে দুটো মামুলি কথা,
আর গভীর-ক্ষরা প্রেম ঠোঁটে মেখেছে।

হায়, জীবনটাই গেছিল খরচে
ভালোবাসার অনটনে
তুমি এলে, ভালোবাসলে
ছলছল এ চোখে এখন শুধু
তারই অনির্বাণ রেশ।
কবিতাঃ ভালোবাসি প্রিয়!

কী করে বলি!

কী করে বলি
তোমায় কতটা ভালোবাসি!
শব্দের নেই যে অত সাধ্য,
বুঝিয়ে বলে তুমি আমার
কতটা আরাধ্য।
কী করে বলি তোমায় কতটা চাই?
কাটে না দিন, কাটে না নিশি
রিক্ত রোদনে যায় যে ভাসি।
কী করে, কোন্‌ মন্ত্রবলে
এইক্ষণে তোমায় কাছে পাই!
কী করে বলি
তুমি শুধু আমার, আমার!
কাব্যের কী সাধ্য
বলতে পারে তোমায় চেয়ে
দিয়েছি কত শত
ব্যথাতুর নৈবেদ্য!
কী করে বলি
তুমিই ফুল, তুমিই বাহার
নিঃস্ব এ জীবনে তুমিই মম
বেঁচে থাকার নীরব অহংকার!

তোমাকে চেয়ে এইসব দিনরাত্রি!

আজকাল প্রায়ই থাকি বাকরুদ্ধ। 
চোখেতে টলমল অবাধ্য অশ্রু
ভারী হয়ে থাকে, নামে না।
যেন মনোভারে মেঘ কালো – ভীষণ গাঢ় 
ঝরতে চেয়েও ঝরে না।
আজকাল প্রায়ই ভাবি তার কথা 
আলগোছে শ্বাস ফেলি – হৃদয়-কাটা! 
বুকে শুধু পেয়ে হারানোর ভয়
কেন এলে এই নিঃস্ব জীবনে, 
যদি আবার চলে যেতে হয়?
আজকাল সময় কাটে বড্ড ব্যাকুল
ঘটনার স্রোত বয়ে যায় নিত্য – মাড়িয়ে যায়
অথচ আমি থাকি বেভুল! 
উজানে পেতেছি বুক যদি তাকে পাই
সব আঘাত নেব সয়ে হাসিমুখে
কী করে বলি, তোমাকে কতটা চাই!
আজকাল চোরা নীরবতায় আকণ্ঠ ডুবে থাকি
কেউ জানে না, দেখে না 
বুকের কোথায় কী গভীর ভাংচুর,
কী অসহ বেদনা গাই অপ্রকাশের ধ্রুব ছন্দে! 
চোখেতে টলমল অবাধ্য অশ্রু
নেমে পড়ে আপন খেয়ালে। 
রক্ত ঝরায় না-বলা শত কথায়
সে যে স্থান-কাল কিছুই মানে না!

ভাল নেই আমি!

কেউ জানে না এ ব্যথা কোথায় গিয়ে জ্বালায়?
কেউ বোঝে না এ অনাদর কোথায় গিয়ে কাঁদায়?
আমায় যত পার দুঃখ দিয়ে যাও, কিছুই বলব না।
যত পার আঘাতে কর রক্তাক্ত, তবু ক্ষত দেখাব না।
কেউ জানে না চেয়ে চেয়ে কেবলি দেখি শিখরের স্থানচ্যুতি।
কেউ বোঝে না আলগোছে কখন ক্ষয়ে যায় হৃদয়ের মোহন দ্যুতি!
আমায় যত পার উপেক্ষা করে যাও, প্রতিবাদ করব না।
যত পার প্রচ্ছন্নে সরিয়ে দাও বাড়িয়ে দেয়া হাত, অভিযোগ করব না।
কেউ জানে না কোন্‌ গভীর ব্যথায় নীল হয়ে আছি এই আমি…
কেউ বোঝে না কোন্‌ অব্যক্ত অভিমানে কী বড্ড খারাপ আছি!
আমি ভাল নেই, সত্যিই ভাল নেই। তুমি কি বেশ আছ?
আমায় পুড়িয়ে কোন্‌ অনলে স্বস্তির মরীচিকা সারারাত খুঁজেছ?

প্রার্থনা!

একটা ভাল কিছু দাও, প্রভু
একটা অদ্ভুত কিছু দাও।
নিয়েছ সব কেড়ে – কিছুই বলি নি।
দিয়েছ দুখের উষর ভূমি – রা কাড়ি নি।
আর কত ভোগালে একটু তাকাবে?
নিন্দা করবে যে মন্দেরাও…
অন্তত একটা মন্দের ভাল দাও!
 
থেকেই যদি থাক তুমি, মৌনতা ঝেড়ে ফেল।
একটা অভূতপূর্ব কিছু বল।
মুক্তি দাও প্রভু, আমায় মুক্তি দাও।
একটা স্বস্তি মেশান হাসি দাও।
নিয়ে নাও এই জটিল জীবন, কুটিল মারপ্যাঁচ
এই বিদগ্ধ জ্ঞানের অকেজো মুখোশ –
নৈরাশ্যের ক্লেশকর দিন-মাস!
একটা নিছক সাদাসিধে জীবন দাও –
প্রত্যাশা বিহীন…
আমায় একটা ভাবনাহীন প্রহর দাও
যার কবোষ্ণ আলোয় দেখব গহীনের আমিকে।
যতই থাকুক অপূর্ণতা কিংবা পতনের হাহাকার,
ভালবাসব তাকে। যত দীন হোক না সে
তুলে নেব এই দু’হাতের অতল-ছোঁয়া স্পর্শে!
একটা নির্বোধের জীবনই দাও তবে!
ডুবে থাকি দিন-আনি-দিন-খাই সুখের
কন্টকহীন প্রস্রবণে!
 

একটা ভাল কিছু দাও প্রভু,
একটু দয়া দেখাও।
কারুকাজের জটিলতা আর চাই না – ফিরিয়ে নাও।
আমায় আনমনে একটা সহজিয়া সুর ভাজতে দাও!