নীরব অভিমান

চোখ ভরে আসে তপ্ত জলে,

কার উপর কীসের অভিমানে

বুকের জমিনে আহত শ্রাবণ নামে?

কী দিই জবাব যদি কেউ শুধায়?

জানা নেই, কিছু যে জানা নেই

কেন কাঁদে এই মন ব্যাকুল নিরুপায়।

দৃষ্টি যে তার শূন্য মলিন উদাসে

বুক ভাঙে পাঁজরের সস্তা দামে!

কে রোধে কণ্ঠ সারাবেলা

এই বিষন্ন আকুলি হুতাশে?

চোখ ভিজে যায় নোনা সন্তাপে

অমোঘের মেঘে জ্বলে

না পারার নি:স্ব প্রখর দহন।

কে হাসে যা কিছু ঘটেছে ভালো

তার সবটুকু আমূল খুইয়ে,

সর্বহারার উথল অভিমানে?

তাই নীরবতা, তোমায় চেয়েছি কাছে।

তুমি যে আজ আমার

বড়োই একান্ত আপন!

ফ্লার্টিং

– আপনার নামটা যেন কী?

নাম তো আমি বলিইনি!

– বলেননি! এখন তবে বলেন।

চাইলেই সব হয়, তাই বুঝি ভাবেন?

– নামই জানতে চেয়েছি, ঠিকুজি না!

বললেই সব উগরে দেবো, তাই না?

– আপনাকে চিনি না, ঝগড়া আমি চাই না

ওমা, কোথায় ঝগড়া? এ তো বাস্তবতা!

– আপনার দেখছি বড্ড বেশি দেমাগ!

সবারই তাই থাকে হলে খানিকটা সজাগ।

– হার মানছি, কেন মিছে লড়ে মরছি?

কে চেয়েছে? দিন না লড়াইয়ে যতি!

– আচ্ছা, এখন তবে নামটা পেতে পারি?

ও বাবা, কীভাবে? পরিচয় হলো নাকি?

– সেকি! হয়নি? এই তো আছি পাশাপাশি দিব্যি।

আপনি বড্ড গায়েপড়া, এভাবে কেউ বলে কি?

– আহা, নামই শুধু জানতে চেয়েছি, অন্যকিছু চাইনি!

এভাবেই সবে বলে, ভাজা মাছটি যেন উল্টোয়নি!

– আপনি তো দেখি অসাধারণ পেঁচুক!

কেউ জানি কলিকালের সরল ভাবুক!

– উফ! পেরে ওঠাই দায়, দস্যি মেয়ে বাবা!

এবার তবে থামি, কথা না বাড়ুক, টাটা।

– কিন্তু এ লগ্ন প্রেমের আবিরে মগ্ন, যাবে বৃথা?

ওমা, কবি নাকি? পালিয়ে বাঁচি, নেই যে আশা!

– অনেক হয়েছে, এবার নাহয় একটু মিল করি?

কী চাইছেন, তাই তো জানিনা, কীসে হবে কী?

– নামটা যেন কী? দুত্তরি ছাই, তলই না পাই!

নাম কটকটি। চলবে? নইলে আর না এগোই।

– হা হা হা, তবে ছলনা নয়, সত্যি?

হি হি হি, তাহলে আর বলছি কী!

বিজনবাবুর লঘুদণ্ড

এখানটায় একটু বসতে পারি?

প্রশ্নটা শুনে বিজনবাবু বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।

এটা পার্কের পাবলিক বেঞ্চ। সবারই বসার অধিকার আছে। আমাকে অহেতুক জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? ইতোমধ্যে বিজন শীলের ভ্রুটা কুঁচকে গেছে।

তাতে অবশ্য আগুন্তুকের কোনো ভাবান্তর হলো না। একগাল হেসে ফেললেন।

স্যার মনে হয় বেশি কথা পছন্দ করেন না? ভদ্রতা করেই জিজ্ঞেস করেছি। আজকাল ভদ্রতা কিংবা সম্মান কেউ করে না, তাই না?

তা করবে না কেন? খুব করে। বামপাশেই তাকিয়ে দেখেন। লীলা চলছে, লীলা।

মধ্যদুপুরে একটা ঝোঁপের ফাঁকে কলেজ পালানো দুই তরুণ-তরুনী বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গ হয়ে বুঁদ হয়ে আছে একে অপরে। আশেপাশে কে দেখছে কোনো ভাবান্তরই নেই, লজ্জাও নেই!

সেদিকে তাকিয়ে আবারও হেসে ফেলল আগুন্তুক।

ওদিকে না তাকালেই হয়। আপনি দেখছেন কেন?

আমি দেখছি কেন? পোড়াচোখ এখনও সবই দেখে। আচ্ছা, নাই দেখলাম। কানে তো আর খাটো হয়ে যাইনি। রিটায়ার করেছি কিন্তু সব ইন্দ্রিয় তো দান করে দিইনি!

স্যার খুব সুন্দর কথা বলেন। কী পড়াতেন? বাংলা?

এই যে তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছেন, আপনি কে বলেন তো? বিজন শীল মোটা বাইফোকালের ভেতর দিয়ে উৎসুক মুখে চেয়ে থাকেন। আমার প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ নয়তো?

কেন, স্মৃতি কি ক্ষয়ে গেছে? ইন্দ্রিয় তো সব ঠিক আছে শুনলাম। হাহা।

দেখেন, এমনিতে আমার মেজাজ ভালো নেই আজকে। বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে বসে আছি এই জঘন্য প্রেমমঞ্চে। আমার সাথে মশকরা না করলেই খুশি হবো।

মাফ করবেন যদি মশকরার মতো শোনায় আমার কথা! আচ্ছা, ত্রিশ বছর আগে একটা দুপুর মনে করিয়ে দিই। তখন করিমগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলাই পড়াতেন। বছর দশেকের একটি ছেলে বাংলায় বড়ো কাঁচা ছিল। সে পড়তে আসত আপনার কাছে। আপনি তার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অনুরক্ত শব্দটার সঠিক প্রয়োগ হয়েছে তো, স্যার?

কে, কে আপনি?

তারপর একদিন সুযোগ বুঝে এমনি চৈত্রের কোনো এক দুপুরে আপনি তাকে জবরদস্তি করলেন।

এই, আপনি থামবেন? কীসব বকতে লেগেছেন? কে আপনি? চেঁচিয়ে ওঠেন বিজন শীল।

চেঁচাবেন না। কাহিনিটা শোনেন আগে। তারপর যুবক বিজন শীল বড়ো ঘাবড়ে গেল। ভয়ার্ত শিশুটিকে দেখে নিজের অনিবার্য পতন দেখতে পেলেন। অতঃপর দুহাতের জোর দেখালেন কচি গলার চারপাশে। জংগলের গভীরে পরিত্যক্ত কুয়ায় ফেলে দেবার আগে বিস্ফারিত চোখের ভাষাটা কি মনে পড়ে, স্যার?

কে, কে তুমি? তপন?

আমি কে সেটা ব্যাপার না! আপনাকে শুধু মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। খুব ভালো। স্মৃতিতে এখনও মরচে ধরেনি তাহলে?

বাবা তপন! আমাকে ক্ষমা করে দে, বাবা! আমার ভুল হয়েছিল। হাতজোড় করেন বিজন।

ক্ষমা? খুব সহজ না, স্যার? আমি চাইলেই আপনাকে চরম শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু সেটা করব না। আপনাকে গুরুপাপে লঘুদণ্ডই দিলাম। যান, লঘুদণ্ডই নিন। বিদায়!

পরের যা ঘটল তা স্রেফ ইতিহাস। আজকের টিকটক প্রজন্ম লুফে নিল দৃশ্যটা। ঘন্টায় লাখ ছাড়িয়ে গেল শেয়ার।

শহরের একমাত্র পার্কে মধ্য দুপুরে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে কিছু অত্যন্ত আপত্তিজনক কুরুচিপূর্ণ যৌন ভঙ্গীমায় দেখা গেল। বুড়োটা শূন্যের সাথে বেকুবের মতো কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে!

বিজন শীল সজ্ঞানেই সব করছেন। বেশ বুঝতে পারছেন কী করছেন, কিন্তু তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই! অন্যভুবনের কেউ যেন নিদারুণ রোষে সব করিয়ে নিচ্ছে।

বিজনের মনে হলো এর থেকে মৃত্যুই ভালো ছিল!

সাক্ষাৎকার

‘স্যার কি চলে যাচ্ছেন?’

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে বছর সাতাশ কিংবা আটাশের এক মেয়ের হন্তদন্ত মুখে প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন সদ্য চল্লিশের কোঠায় একজন সৌম্যদর্শন মানুষ।

প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে তিনি শহরের বেশ নিরিবিলি এই জায়গায়টায় অপেক্ষা করেছেন। তাঁর সময়ের দাম আছে। সময়ের অপচয় তিনি ভালোবাসেন না। তবুও অপেক্ষাটা করেছেন কারণ প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা রাখেন এ সময়ের প্রখ্যাত রহস্য গল্প লেখক অধ্যাপক আহমেদ হাসিব।

একটা ফোন অবশ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। তাঁর বিশ্বাস যা ঘটে, তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। রহস্য থাক বা না থাক। তিনি আগ্রহভরে অপেক্ষা করেন কখন সেটি স্বমহিমায় প্রকাশ পাবে।

‘হ্যাঁ, সেরকমই আমার ধারণা!’ ভারী কাচের চশমা ভেদ করে ভীষণ গাম্ভীর্য এনে দুই ভ্রু উঁচিয়ে উত্তর দিলেন আহমেদ। মেয়েটি হকচকিয়ে গেল।

সরি, স্যার। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার না কোনো উপায় ছিল না। সাক্ষাৎকারটা আমার খুবই দরকার। খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল অনসূয়া।

এবারে আহমেদ হেসে ফেললেন। চমৎকার ভুবনভোলানো হাসি।

এত লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। যদিও রিপোর্টার হয়ে দেরী করে আসাটা ভালো কথা নয়। কিন্তু আমি কিছু মনে করিনি। আমার আরেকটা জায়গায় যাবার কথা আছে। এজন্য আর অপেক্ষা না করে উঠে পড়েছি। কী যেন নাম আপনার?

অনসূয়া, স্যার।

হ্যাঁ, অনসূয়া এবারে তাহলে আর হলো না! আরেকদিন হবে, কেমন?

অনসূয়া শশব্যস্তে হা হা করে উঠল। আপনার বেশি সময় নিব না, স্যার। ঐ পার্কের পাশেই তো পার্ক করেছেন আপনার নিশানটা। ওখানে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হোক যদি অনুমতি দেন?

ভালোই নাছোড়বান্দা দেখছি আপনি! আচ্ছা, চলুন। পাঁচ মিনিটের বেশি কিন্তু আমি দিতে পারব না। ওকে, শুট!

শেষ বিকেলে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। পার্কের শতবর্ষী গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে কমলাটে কুসুম আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। এতক্ষণে ভালো করে খেয়াল করলেন অকৃতদার আহমেদ। মেয়েটি ভীষণ সুশ্রী। চমৎকার দেহসৌষ্ঠব। উচ্চতাও গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের থেকে বেশি।

আচ্ছা, শুরু করা যাক। স্যার, ভূত কি আছে?

সত্যি বলব? না, ভূত নেই! সব বাজে কথা।

সেকি, স্যার! ভূত-প্রেত নিয়ে লিখেই যাচ্ছেন প্রায় দশ বছর। এখন বলছেন, ভূত নেই!

দেখুন, লেখাটা একপ্রকারের মনোরঞ্জনের বিষয়। মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। যা সে জানে না, সেটা নিয়ে মানুষের নানান জল্পনা থাকে। আসলে আঁধারকে ভয় মানুষের। আমরা সেটিকেই ভাঙিয়ে খাই আরকি!

এটা কি অফরেকর্ড রাখব?

না, সবই ছাপতে পারেন। যারা বিশ্বাসী, তাঁদের আপনি এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়েও কিছুই বুঝাতে পারবেন না। আঁধারের ভয় এক অদ্ভুত জিনিস। ভয়ের সাথে তীব্র আকর্ষণও। ব্যাপারটা হয়তোবা শুরু হয় মাতৃজঠর থেকে। আঁধারের মধ্যেই তো ডুবে থাকি। অতঃপর আলোর সন্ধানে বের হয়ে আসি। তারপর কোনো এক অব্যখ্যেয় কারণে সব ভুলে যাই। অন্ধকারের প্রাচীন অভিজ্ঞতা তখন অজানা ভয় হয়ে চেপে থাকে।

তাহলে এই যে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নানা ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, সেগুলি শুধুই জল্পনা-কল্পনা?

হ্যাঁ, ভালো করে খতিয়ে দেখলে বুঝা যাবে, সবকিছুর পেছনে কিছু না কিছু কার্যকারণ আছে। ভূত স্রেফ কল্পনাপ্রবণ মনের আদুরে বিলাসিতা।

আচ্ছা, আপনার জীবনে কি কোনো ভৌতিক কিংবা অলৌকিক কিছু ঘটেছে?

টাইম ইজ টিকিং, ইয়াং লেডি! আর দুই মিনিট।

তাহলে দ্রুত বলেন। আমি বেশি সময় নিব না।

অনেস্টলি বললে, ভূতের দেখা আমি পাইনি এখনও। কিন্তু আমার কল্পনাটা আবার বড়োই বিস্তৃত। অসুবিধা হয় না। বরঞ্চ নিজের লেখা পড়ে বেশ বিস্ময়াভিভূতও হই মাঝেমধ্যে।

মানে বলছেন যে সবচে ভালো ভূতের গল্প আসে নিতান্ত ভূতে অবিশ্বাসীর কাছ থেকে? আপনার মতো একজন প্রথিতনামা লেখকের সৃষ্টি কিন্তু সেটাই নির্দেশ করছে।

আমার লেখার গুণ নিজে বিচার করতে পারি না! তবে, বলতে গেলে ব্যাপারটা সেরকমই। হাহাহা।

আচ্ছা, স্যার আর বেশি সময় নিব না। সময়ও নেই আমার! ক্লিক করে ছোট্টো রেকর্ডারটা বন্ধ করে অধ্যাপক আহমেদের হাতে দিয়ে দিলো অনসূয়া।

এটা তো আপনার রাখার কথা! আমাকে দিচ্ছেন কেন? অবাক হয়ে গেলেন আহমেদ।

স্যার, আপনার নিশানটা বোধহয় রাস্তার ওপারে। দেখুন তো একটু?

আহমেদ সেদিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওটাই আমার!

তারপর পাশ ফিরে আরও কিছু বলার জন্য ফিরে দেখলেন, অনসূয়া নেই। আজব ব্যাপার তো! কিছু না বলেই চলে গেল! বিদায় বলার সংস্কৃতি বোধহয় উঠে যাচ্ছে এখন। এমনই ঝপ করে আসে, ঝপ করে যায়। কী একটা অদ্ভুত জেনরেশন!

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আহমেদ আর দাঁড়ালেন না।

গাড়িতে বসেই একটা কল পেলেন সাপ্তাহিক রোমাঞ্চের সম্পাদকের কাছ থেকে। খবরটা শুনেই প্রচণ্ড ধাক্কায় বিহ্বল হয়ে গেলেন অধ্যাপক আহমেদ হাসিব। রহস্য বিষয়ক রিপোর্টার অনসূয়া আবেদীন সাক্ষাৎকার নেবার জন্য বের হয়ে গুরুতর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সৌজন্যবশত তাঁকে খবরটা জানালেন।

এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে একবারও অদ্ভুত অব্যাখ্যেয় কিছু ঘটেনি তাঁর জীবনে। তবুও নিরন্তর লিখে গেছেন কল্পনার জাল বুনে। আজ একটি ঘটনা সব ওলটপালট করে দিলো। এতক্ষণ কাকে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি? গায়ে একেবারে কাঁটা দিয়ে উঠল।

আহমেদ হাসিব সেই যে লেখা ছেড়েছেন, আর কোনোদিন কিছু লিখেননি। তবে, এখনও মাঝেমধ্যে রেকর্ডকৃত আলাপটা শোনেন তিনি। মেয়েটি তাঁকে এভাবে জব্দ করে চলে যাবে, ভাবতেও পারেননি কখনও! মেয়েটির জন্য একটা অদ্ভুত ভালোবাসা লালন করতে থাকেন তিনি।

দশটি অনুকবিতা

১. 

মন্দির জ্বলে, মসজিদ ভাঙে

লোভী হায়েনারা হাসে।

বিশ্বাস পুড়ে, শেকড় ছিঁড়ে

কে দেখে মানবতা কাঁদে?

২.

আমি তোমাদের কেউ নই

কেউ নও তোমরা আমার।

তবুও থাকি পাশাপাশি

যেন চিনি জন্ম-জন্মান্তর!

৩.

দিনগুলি গড়াচ্ছে দ্রুত

যেন বল্গাহীন ত্বরণ

নুয়ে যাচ্ছি, ক্ষয়ে যাচ্ছি

বিদ্রুপে অমোঘ মন্দন!

৪.

নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবো

কী ভয়ানক মূঢ়তা!

তুমি যে কিছুই নও

জানো কি পরম সত্যটা?

৫.

ভিড়ের মাঝেও একা আমি

তুমিহীন শূন্যতা

কোলাহলেও নৈশব্দ ছুঁই

বুঝ কি এই যন্ত্রণা?

৬.

ভালোবাসতেই হবে এমনটা নয়;

অনাদরে রেখো না।

আড়ম্বরের চুম্বন নাইবা পেলাম

শুধু অনীহা পুষো না!

৭.

হাসিমুখ তোমাদের বিস্মিত করে

সুখ তোমরা পাও না।

চোখের তারায় নিখাদ দুর্বোধ্যতা

দুখও তোমরা জানো না।

৮.

জীবনের কোনো বিশেষ মানে নেই

এবেলা স্বীকার করে নাও।

যাপনের কোনো দৃঢ় কারণও নেই

অহেতুক মোহপাশে যতি দাও।

৯.

মুখে বলো ভাই ভাই

ভেতরে ঘৃণার সীমা নাই।

মনে নাকি কিছু নাই

অথচ নিনাদে নিকুচিটাই!

১০.

যার যার আমিটাই বড়ো

আর সব ফাঁকা

অহংভারে পিষ্ট থাকো

চক্ষু দুটি বাঁধা।

কাকে বলি?

কাকে বলি?
কেউ নেই শোনার।
প্রতিদিন যে একটু একটু করে মরে যাচ্ছি!
নিত্যদিন একই নামচা –
কেবলই আসে যায়, আহা!
একঘেয়ে প্রভাত, রোদনভরা আকাশ
এবং রংজ্বলা সায়াহ্নের সন্ন্যাস…
আর এক গুচ্ছ হৃদয়হীনতার
অগভীর ক্লেদাক্ত স্পর্শ!
ভেতরে ভেতরে কী যে ভীষণ ক্ষয়ে যাচ্ছি
কেউ নেই দেখার!
শুধুই কান্তিহীন অমোঘ রাত্র –
মেকি সুখে কী ভীষণ
অভিমানী বিমর্ষ!

আন্তর্জালিক মিছে অহং!

আজকাল কিছুই বলা বারণ
মুখে মারো তালা!
সকলই সেজেছে আজ বোদ্ধা
অন্তর্জালের তুমুল তুখোড় ভুঁইফোড় যোদ্ধা!
আজ সবাই-ই জ্ঞানী, সবই জানে,
অজানা নেই কিছুই!
ভেতরে যে মজা নদী কিংবা হাঁটু জল
কে রাখে খবর তার? ভাসাভাসা সবই।
আজ মূর্খের দাপট, হাতের ডগায় বিদ্বেষী কপট
কে হয় সাহসী? বলে দেয় তুমিই ভুল
কথায় নেই নূন্যতম যুক্তি-জ্ঞানের বহর!

ইদানীং সবাই বড্ড স্পর্শকাতর
তাই মুখে মারো তালা!
সব কথাতেই দোস্ত বেজার
উচিত কথায় মানীর মান উজাড়।
আজ সবাই একশ একাই
আহা, কমতি যে নেই কিছুই!
বলতে গেলেই ফেঁসে যাবে,
জিভের ডগায় লাগবে যুদ্ধ
আর আঙুলে পারমাণবিক মৃত্যু!

অন্তর্জালে সবাই যে আজ জিম্মি
আপন আপন অহং বৃত্তে।
কেউ বুঝে না এসবই ফাঁপা
মূল্য নেই এতটুকুও,
নিছক নির্বুদ্ধিতায় যে মাপা!
হতে গেলে সরব, নীরবতা শেখো আগে
গভীর হও – তাতেই যে সব অনুপম সৃষ্টি!

~~অনিকেত উদাসীন~~

সব বদলে যায় না!

বদলায় মানুষ, বদলায় জীবন।
বদলে যায় জীবনের বাহারি খোলস।
বদলায় ভালোবাসা, বদলায় বাঁচার টুকরো আশা।
আর বদলায় মানুষের মুখোশ!

এত কিছু বদলের ভীড়ে,
নিজেরে খুঁজি দল বদলের ব্যস্ত তীরে।
শুনি কেবল ব্যর্থতার অদ্ভুত গুঞ্জন!
মন আমার অচিন পাখি,
কেন রাখল পুষে কবেকার প্রাচীন স্মৃতি?
ঠিক বহুকাল আগেও ছিল যেমন!

বদলে যায় পৃথিবী, বদলে যায় সময়।
শুধু আমিই ভুলে যাই কীভাবে বদলে যেতে হয়।
রয়ে যাই অনড়, দাঁড়িয়ে থাকি এক ঠায়
আঃ, আমি ভুলে যাই কীভাবে অমানুষ হতে হয়!

প্রথম প্রকাশঃ ২০০৬

রাত একটা বেজে একত্রিশ মিনিট

রাস্তায় পা দিতেই আকাশের এমাথা-ওমাথা ফালা ফালা করে বিদ্যুৎ চমকে গেল।

নিশুতি এই রাতে লোকজন বেশি থাকার কথা না। অভ্যাসমতো জয়নুল কব্জি ঘুরিয়ে ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে ছোটো কাঁটাটা কোথায় আছে দেখার চেষ্টা করল। ভারী কাচের চশমাটা একটু আগুপিছু করে দেখে বুঝল ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। কীভাবে বন্ধ হলো? সেদিনই না সাতমসজিদ রোডের মাথায় টাইম সিরিজ ঘড়ির দোকানে ঘড়িটা সারিয়ে আনল সাড়ে বারশ টাকা দিয়ে? মেকানিক ছেলেটা খুব দাঁত কেলিয়ে বললো, স্যার নিয়া যান, এক্কেরে নতুনের লাহান কইরা দিসি। এই তার নমুনা! ছেলেটা তাঁরই ছাত্র, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। দুনিয়া জোচ্চোরে ভরে গেছে একেবারে।

রাত দেড়টা দেখাচ্ছে। রাত দেড়টা? কীভাবে? একটু আগেই না বের হলেন? বিপত্নীক জয়নুল আহসান নিজের অসামাজিক খোলস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু নিয়াজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। আসলে নিমন্ত্রণ নয়, বন্ধুপত্নীর আত্নীয়াকে দেখানোই উদ্দেশ্য। বড়ো বিরক্ত হয়েছিল জয়নুল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে নাই। রিমির অকালমৃত্যুর পর একরকম নিজেই দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে খান হাত পুড়িয়ে। ভালো-মন্দ তেমন খাওয়া হয় না। তাই ভিতরে ভিতরে চটে গেলেও ওরকম এলাহি আয়োজনে হাসি-হাসি মুখেই বসেছিলেন। ওদের হাত থেকে ছাড়া পেতে পেতে রাত একটা বেজে গেছিল। সাতমসজিদ রোড ধরে মাত্র পাঁচ মিনিট হেঁটেছেন। তাহলে দেড়টা হবে কেন? ঘড়িটা কি আগে থেকেই বন্ধ ছিল?

হঠাৎ ভীষণ ধন্দে পড়ে গেলেন। পিছনের ঘটনাগুলি মনে করতে গিয়ে সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। অথচ ছোটোখাটো ব্যাপারগুলি উনি খুবই মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে থাকেন। নোটও লিখে রাখেন। মনে পড়ছে বিয়ের কিছুদিন পর রিমির সাথে তাঁর বিরাট মনোমালিন্য এই নোট নিয়ে। বাসর রাতের পর নোটে লিখে রেখেছিলেন, ঈষৎ নাসিকাগর্জন সমস্যার কারণ হতে পারে যদিও নাকটা বাঁশির মতো আর পর্বতযুগলে সিমেট্রি নাই তেমন ইত্যাদি!

অনেক বছর আগের কথা মনে করে হেসে ফেলেও গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু স্মৃতি বোধহয় কোনো দিনই ফিকে হয়ে যাবে না। রিমিকে ভোলা অসম্ভব প্রায়! ঠিক তখনই খেয়াল করলেন ধূলির এক প্রকারের ঝড় উঠেছে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভাগ্যিস ছাতাটা সঙ্গে করে দিয়েছে ভাবি। এই তো ছাতার কথাটা দিব্যি মনে করতে পারছেন। ঘড়িটা কেন মনে করতে পারছেন না?

প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। বাংলা কী মাস এটা? আশ্বিন নাকি ভাদ্র? আবার দ্বন্দ্ব লেগে গেল। যেটাই হোক, এরকম ঘোর বর্ষা তো হওয়ার কথা না। ছাতাটা পুরোনোই বটে। ছাতার ফ্যাঁকাসে মেটে রঙের জীর্ণ কাপড়ের মধ্য দিয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির কণা চশমার কাচে দিব্যি জমে যাচ্ছে। বাইরে মোটামুটি তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রবল ঝড়ে গাছের মাথাগুলি যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে। বিপজ্জনকভাবে দুলছে। ও কী, ভেঙে পড়বে নাকি? ছাতার বাঁট শক্ত করে ধরে রাখতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময়ে ছাতাটা উড়েই যাবে।

রিমি মারা যাবার পর ইশ্বরে আর বিশ্বাস নেই জয়নুলের। বহুদিন প্রাকটিস করেন না। অথচ নিতান্ত অভ্যস্ততায় দোয়া ইউনুস বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন। চূড়ান্ত অন্যমনস্ক বলে বিপরীত দিক থেকে আসা অটোটা ঠিক খেয়াল করলেন না।

ঘ্যাচাং করে থেমে গেল অটোটা। সাথে একটা অশ্রাব্য খিস্তি। আর একটু হলে মাড়িয়ে দিচ্ছিল আর কি!

কৌতূহলে ছাতাটা কাত করে দেখলেন অমাবস্যার মতো কালো বদখত একটা লোক মাথাটা বাড়িয়ে গালির তুবড়ি ছুটিয়েছে। দোষটা তাঁরই। কোন্‌ বদ খেয়ালে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটছিলেন, কে জানে? জয়নুল কিছু বলেন না। শুধু মাথাটা নাড়িয়ে পাশের ফুটপাথে উঠে গেলেন। তখনই দেখতে পেলেন নেমে যাওয়া যাত্রীকে।

মিস রোজি। এক ঝলক দেখেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। এইসব সঙ্গ যথাসম্ভব পরিত্যাজ্য। কথাও বলতে চান না তিনি।

ফুটপাথের জায়গায় জায়গায় পানি জমে গেছে। ঝড়জলের রাতে ভিজে চুপসে যাওয়া হাজার পঞ্চাশ টাকা পঁচাত্তর পয়সার বাটা ছপ ছপ ছপ ছপ একটানা শব্দ তুলেছে। বামে মোড় নিলেন জয়নুল। রাস্তাটায় গাঢ় অন্ধকার এমনিতেই থাকে। রাতের বাতিগুলো অধিকাংশই নষ্ট। ঝড়ে অনিবার্য লোডশেডিং -এ আরও নিকষকালো হয়েছে আঁধার। হঠাৎ শুনতে পেলেন আরও একজোড়া পায়ের শব্দ দ্রুত তাঁর দিকে ধাবমান। কেউ কি দৌড়ে আসছে তাঁর দিকে? এ কী বিপদ?

কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা খিলখিল হাসি ছাতার নিচে চলে এলো।

স্যার, আমারে দেইখা পলাইলেন ক্যান? আমি কি বাঘ না ভালুক যে আপনারে খায়া ফালামু?

দামী সিল্কের শাড়ি, উগ্র প্রসাধন এবং সুগন্ধি আর দুর্বিনীত যৌবন… জয়নুলের এ মেয়েটিকে চেনারই কথা। তিনি যে পাঁচতলা বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেটার সবচে উপরের তলায় থাকে মেয়েটি। মিস রোজি এর নাম নয়; এই মেয়েটাকে তিনি ভালোই চেনেন কিন্তু বিচিত্র কারণে আসল নামটা মনে করতে পারছেন না।

বেশ খানিকটা উষ্মার সাথেই বললেন, মিস রোজি, তুমি আমার ছাতার নিচে এলে কেন? বেরিয়ে যাও এখনি।

মিস রোজির তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং দ্বিগুণ হাসিতে ফেটে পড়ল। ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লেন জয়নুল।

মিস রোজি! কী কইয়া ডাকলেন আমারে? স্যার কি আমার নাম ভুইলা গেছেন?

মধুর জলতরঙ্গ ঝড়জলের শব্দ ছাপিয়ে জয়নুলের কানে মধু ঢালতে লাগল। এ অন্যায়! নিজেকে মৃদু তিরস্কার করেন জয়নুল।

মিস রোজিই তো তোমার নাম ইদানীংকালে। ভুল বলি নাই। আর এরকম ভাষায় কথা বলবে না আমার সাথে।

কী ভাষায় কইতাছি? ওরে আমার বিশিষ্ট নাগর! (খিলখিল হাসি)

এই প্রকারের তারল্যে খুবই রুষ্ট হলেন জয়নুল।

তুমি এখনই বের হয়ে যাবে আমার ছাতার নিচে থেকে স্বেচ্ছায় নইলে…

নাহলে কী? ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবেন? দেন দেখি?

হাঁটা থামিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন মেয়েটির দিকে। ঠিক তখনই আকাশ চিড়ে আলোর ঝলকানিতে একটা বাজ পড়ল। সেই আলোতে অনন্যসুন্দর মুখখানি দেখেই চকিতে নামটা মনে পড়ে গেল। রুনু – হ্যাঁ রুনুই তো নাম!

রুনু! কেন এরকম করছ? এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

বহুদিনের অশ্রুত এ ডাকে মিস রোজি রূপোপজীবিনী ক্ষণকালের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে। অতঃপর দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে।

এত রাতে কোথায় গিয়েছিলাম? জানেন না কোথায় গিয়েছিলাম? আপনি বোকার মতো প্রশ্ন করছেন, স্যার।

ওহ সরি! তোমাকে ও প্রশ্নটা করা ঠিক হয় নাই। যাহোক, চলো এগুনো যাক। তাড়া আছে আমার। সময় নাই, পৌঁছাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।

মিস রোজি ওরফে রুনু যে প্রগলভতা নিয়ে ছাতার নিচে এসেছিল, তা নেই হয়ে গেল আলগোছে। এখন কেমন জড়সড় হয়ে হাঁটছে। দামী সিল্কের আঁচল প্রবল বর্ষণে বেশ ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে প্রায় এক দশক আগের অনুপম ফুল রুনুর ছবিটা হঠাৎ ভেসে উঠল। কীভাবে যে সব তছনছ হয়ে গেল!

তুমি আরেকটু ভিতরে আসতে পার। ভিজে যাচ্ছ তো?

আসব? আপনার বিশিষ্টতায় দাগ পড়বে না তো? বাজারি মেয়ে হয়ে গেছি আমি! অকস্মাৎ খুব করুণ শোনাল কন্ঠটা।

জয়নুল মরমে বিদ্ধ হয়ে গেল যেন বাজারি হওয়ার পেছনে সেও দায়ী। অথচ তা তো নয়। গল্প শোনার মানুষ নয় জয়নুল। কাটখোট্টা ধরনের। তবুও একটা ইচ্ছে যেন অস্থির আঁকিবুঁকি কাটছে। অথচ অদ্ভুত একটা ভাব হচ্ছে, মনে হচ্ছে সময় বেশি নেই। গল্পটা শোনা হবে কিনা বুঝতে পারছে না।

রুনু, কীভাবে এসব হলো?

মানে জানতে চাচ্ছেন কীভাবে রুনু চৌধুরি মিস রোজি হলো? কী লাভ এসব জেনে?

লাভ হয়তো নাই, কিন্তু বিশ্বাস কর দুই বছর আগে যখন তোমাকে প্রথম আবিষ্কার করলাম মিস রোজি হিসেবে, আমার উচিত ছিল সবটুকু জানাটা। এটুকু সৌজন্য তোমার প্রাপ্য ছিল। আমি সেটুকুও দিতে পারি নাই। কী এক প্রচণ্ড অভিমানে তোমার সঙ্গ এড়িয়ে চলেছি। তোমার কাছে যে আমার ঋণের শেষ নাই!

ছি ছি জয়নুল ভাই, এসব কী বলছেন! আমি আপনাকে কোনো দয়া করি নাই। আমি যে আপনাকে চেয়েছিলাম!

রুনু!!

কী, এই এত বছর পরেও আমাকে বকবেন? যেমন বকেছিলেন প্রথম ধরা পড়ার পর।

জয়নুল অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

স্যার, দোষ আমারই ছিল। আপনি পড়াতে এলে আমি শুধু আপনাকেই দেখতাম। কী ভীষণ মেধাবী একটা ছেলে ফিজিক্সের মতো চরম ফালতু একটা সাবজেক্ট পানির মতো বুঝিয়ে দিত! আপনার বুদ্ধিদীপ্ত স্বপ্নীল চোখ আর ক্যাবলাকান্ত হাসি… হায়, আঠারো বছরের একটা মেয়ের জন্য যে কী হতে পারে, সে বুঝার মতো মনই আপনার ছিল না।

এক্সকিউজ মি! ক্যাবলাকান্ত হাসি আবার কী? রেগে ওঠে জয়নুল।

বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই! গলিতে হাঁটুসমান পানি জমে গেছে। শো শো শব্দে আরও জোরে বাতাস ফুঁসছে। মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে আশেপাশে কোথাও। সেরকম একটা শব্দে আরও ঘন সন্নিবেশিত হয়ে যায় রুনু জয়নুলের। রুনুর গুরুভার বক্ষের স্পর্শে চমকে ওঠে জয়নুল! বহুদিনের অনাস্বাদিত রক্তমাংসের স্বাদ বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে যেন সহসাই উঠে আসে। কিন্তু জয়নুল কোনো অন্যায় সুযোগ নিতে চায় না। হোক সে হাইক্লাস রূপোপজীবিনী। প্রবল নিয়ন্ত্রণে চকিতে সরে আসে।

ও কী, ভয় পেলেন নাকি স্যার? খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রুনু। অভাবে দেহ বেচি ঠিকই, তবে আপনাকে ফাঁদে ফেলার কোনোই অভিরুচি নাই আমার।

না, না ভুল বুঝবে না।

না, আমি ভুল বুঝি নাই। চিরকালের আদর্শবাদী! আপনাকে একটা সময় খুব ঘৃণা করতাম জানেন?

এখন করো না?

নাঃ, সে মনই তো আর নাই। সব মরে গেছে। বাবা মরে যাবার পর আমাদের অনেক সম্পত্তি বাবার ব্যবসার ঋণ চুকাতে খরচ হয়ে যায়। বাকীটা আমাদের পারিবারিক শত্রুতার জেরে সব হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। আমার পড়া আর এগোয় না। পড়াশোনায় ভালোও ছিলাম না জানেনই তো। মা আর তিন ভাইবোন নিয়ে আমরা ছোটো একটা ভাড়া বাড়িতে উঠে যাই অন্য শহরে। সামান্য সঞ্চয় ফুরিয়ে আসে দ্রুত। অতঃপর একদিন মা-ও…

আমাকে জানাও নাই কেন?

অভিমানে জানাই নাই! কী ছেলেমানুষ ছিলাম, তাই না? আপনি আমাকে প্রত্যাখান করেছিলেন। মনে আছে সে কথা? বয়সের ফারাকের দোহাই দিয়ে যা-তা বুঝিয়ে… আপনি একটা যাচ্ছেতাই। আপনি এত পাষাণ কেন?

আজ এত বছর পর এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে জয়নুল? চুপ হয়ে থাকে। পথ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত চঞ্চল হয়ে ওঠে জয়নুল। কীসের যেন একটা তাড়া! অভ্যাসমতো কব্জি উলটে দেখে ঘড়িটা। এখনও থেমে আছে সময়।

রাস্তায় খানাখন্দ আগেই ছিল। এই আকস্মিক প্লাবনে সেগুলির ঠাহর করা মুশকিলই বটে! তারই একটাতে এই ঝড়জলের দুর্যোগে পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। হলোও তাই। কিন্তু সিনেমার মতো মেয়েটা পড়ল না। পড়ল জয়নুল।

ছাতাটা উলটে ভেসে গেল। কোনোমতে জয়নুলকে ধরে রেখে পানিতে পড়ে যাবার হাত থেকে বাঁচালো রুনু।

এবার কোমরটা ছাড়লে ভালো হয়। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রুনু।

অপ্রস্তুত জয়নুল তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে যায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরও জোরে চেপে ধরে।

অঝোর ধারায় ঝরে যাচ্ছে বাদল। রুনুর সিল্ক ভিজে একশা। লেপ্টে রয়েছে শরীরে। জয়নুলের চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। অদ্ভুত পরিবেশ – অদ্ভুত সময় – অদ্ভুত যোগাযোগ! দুটি ঠোঁট কখন যে কী আজন্মের উত্তর খুঁজতে থাকে, কেউ জানে না। বুঝতে পারে না। দুর্যোগের ঘনঘটা ভিতরে এবং বাইরে। জয়নুলের সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে গেল।

ধাতস্থ হলে দুজন ছিটকে যায় দুদিকে। কিন্তু পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। এ কি ক্ষণকালের মোহ নাকি বহুকাল আগের অবহেলিত অস্বীকারী দুর্নিবার আকাংখা? দুটি হাত কেমন চিরচেনা আশ্বাসে গভীর আশ্লেষে পরস্পর ডুবে থাকে।

গন্তব্য কাছে আসতে থাকলে জয়নুলকে বেশ আন্দোলিত দেখায়। পাঁচতলা দালানের সামনে এসে থেমে পড়ে। কড়াৎ শব্দে একটা বাজ কাছে কোথাও পড়ে। ঝটিতি হাত ছেড়ে দেয় জয়নুল।

প্রবল দুঃখভরে রুনু বলে, ওঃ, বুঝতে পেরেছি। ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সীমানা!

জয়নুলের বুকটা হাহাকার করে ওঠে। তাড়াতাড়ি রুনুর হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরে। রুনু, ভুল বুঝো না! আমি তোমার উপরে অন্যায় করেছিলাম। সব বুঝেও তোমাকে প্রত্যাখান করেছিলাম অথচ তুমি তোমার সর্বস্ব দিয়ে আমাকে চেয়েছিলে। সব সঞ্চয় দিয়ে আমার পড়ার খরচও যুগিয়েছিলে। কেন করেছিলে? কেন, কেন? শোনো রুনু, সময় আর বেশি নাই। সত্যটা বলে যাই। আমি তোমাকে… রুনু জয়নুলের মুখে হাত রাখে।

বলতে হবে না, আমি জানি এবং বরাবরই জেনে এসেছি।

হঠাৎ জয়নুলকে বেশ শান্ত দেখায়। যত অস্বস্তি এবং দ্বন্দ্ব ছিল সব মিলিয়ে গেল কর্পূরের মতো। সব পরিষ্কার লাগছে এখন।

গেটের কাছে মাথা ঢুকিয়ে রুনু জয়নুলকেও ডাকে ভিতরে। কিন্তু জয়নুল নড়েন না।

তুমি যাও, রুনু। আর হয়তো দেখা হবে না! বিড়বিড় করে বলেন জয়নুল।

শেষ কথাগুলো শুনতে পায় না রুনু। যদি শুনতে পেত তাহলে দেখতে পেত যুগপৎ আনন্দ এবং বিষাদ নিয়ে কী অপার্থিব ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন জয়নুল!

অভ্যাসবশত কব্জি উলটে দেখে রেডিয়াম ডায়ালে মিনিটের কাঁটাটা এক মিনিট এগিয়েছে। একটা বেজে একত্রিশ মিনিট। জয়নুলের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।

একতলায় জটলা দেখে সামনে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে মিস রোজি। সিভিয়ার হার্টএটাকে এইমাত্র মারা গেছেন অধ্যাপক জয়নুল আহসান। দেয়াল ঘড়িতে একটা বেজে একত্রিশ মিনিট।

☼ সমাপ্ত ☼

তোমাকে চাই!

আমি যাহারে চাই কাছে খুব কাছে
পাই না তাহারে, সে যে রয় দূরে বহুদূরে।
এই নিরল বিরল নিঝুম বরিষণে
আহা, কোথায় পাই তাহারে?
আহারে, সুখহীন নিশিদিন এই হৃদমাঝারে
তাহারে চাই, কেমনে পাই?
এ মন যে হায় আর মানে না রে!
আহারে, চাই তাহারে এই বুকের পরে
চেয়ে থাক সেই দুটি চোখ পরম নিষ্পলক,
নিশ্চুপ অলক মেঘভার উচ্ছ্বাসে।
আহারে, এই ব্যাকুল ঝরা রোদনে
কে আসে, অধর রাখে চাতকের ব্যথিত বেদনে?