সাক্ষাৎকার

‘স্যার কি চলে যাচ্ছেন?’

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে বছর সাতাশ কিংবা আটাশের এক মেয়ের হন্তদন্ত মুখে প্রশ্নটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন সদ্য চল্লিশের কোঠায় একজন সৌম্যদর্শন মানুষ।

প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে তিনি শহরের বেশ নিরিবিলি এই জায়গায়টায় অপেক্ষা করেছেন। তাঁর সময়ের দাম আছে। সময়ের অপচয় তিনি ভালোবাসেন না। তবুও অপেক্ষাটা করেছেন কারণ প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা রাখেন এ সময়ের প্রখ্যাত রহস্য গল্প লেখক অধ্যাপক আহমেদ হাসিব।

একটা ফোন অবশ্য করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। তাঁর বিশ্বাস যা ঘটে, তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকেই। রহস্য থাক বা না থাক। তিনি আগ্রহভরে অপেক্ষা করেন কখন সেটি স্বমহিমায় প্রকাশ পাবে।

‘হ্যাঁ, সেরকমই আমার ধারণা!’ ভারী কাচের চশমা ভেদ করে ভীষণ গাম্ভীর্য এনে দুই ভ্রু উঁচিয়ে উত্তর দিলেন আহমেদ। মেয়েটি হকচকিয়ে গেল।

সরি, স্যার। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার না কোনো উপায় ছিল না। সাক্ষাৎকারটা আমার খুবই দরকার। খুব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল অনসূয়া।

এবারে আহমেদ হেসে ফেললেন। চমৎকার ভুবনভোলানো হাসি।

এত লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। যদিও রিপোর্টার হয়ে দেরী করে আসাটা ভালো কথা নয়। কিন্তু আমি কিছু মনে করিনি। আমার আরেকটা জায়গায় যাবার কথা আছে। এজন্য আর অপেক্ষা না করে উঠে পড়েছি। কী যেন নাম আপনার?

অনসূয়া, স্যার।

হ্যাঁ, অনসূয়া এবারে তাহলে আর হলো না! আরেকদিন হবে, কেমন?

অনসূয়া শশব্যস্তে হা হা করে উঠল। আপনার বেশি সময় নিব না, স্যার। ঐ পার্কের পাশেই তো পার্ক করেছেন আপনার নিশানটা। ওখানে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হোক যদি অনুমতি দেন?

ভালোই নাছোড়বান্দা দেখছি আপনি! আচ্ছা, চলুন। পাঁচ মিনিটের বেশি কিন্তু আমি দিতে পারব না। ওকে, শুট!

শেষ বিকেলে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। পার্কের শতবর্ষী গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে কমলাটে কুসুম আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। এতক্ষণে ভালো করে খেয়াল করলেন অকৃতদার আহমেদ। মেয়েটি ভীষণ সুশ্রী। চমৎকার দেহসৌষ্ঠব। উচ্চতাও গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের থেকে বেশি।

আচ্ছা, শুরু করা যাক। স্যার, ভূত কি আছে?

সত্যি বলব? না, ভূত নেই! সব বাজে কথা।

সেকি, স্যার! ভূত-প্রেত নিয়ে লিখেই যাচ্ছেন প্রায় দশ বছর। এখন বলছেন, ভূত নেই!

দেখুন, লেখাটা একপ্রকারের মনোরঞ্জনের বিষয়। মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। যা সে জানে না, সেটা নিয়ে মানুষের নানান জল্পনা থাকে। আসলে আঁধারকে ভয় মানুষের। আমরা সেটিকেই ভাঙিয়ে খাই আরকি!

এটা কি অফরেকর্ড রাখব?

না, সবই ছাপতে পারেন। যারা বিশ্বাসী, তাঁদের আপনি এভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়েও কিছুই বুঝাতে পারবেন না। আঁধারের ভয় এক অদ্ভুত জিনিস। ভয়ের সাথে তীব্র আকর্ষণও। ব্যাপারটা হয়তোবা শুরু হয় মাতৃজঠর থেকে। আঁধারের মধ্যেই তো ডুবে থাকি। অতঃপর আলোর সন্ধানে বের হয়ে আসি। তারপর কোনো এক অব্যখ্যেয় কারণে সব ভুলে যাই। অন্ধকারের প্রাচীন অভিজ্ঞতা তখন অজানা ভয় হয়ে চেপে থাকে।

তাহলে এই যে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নানা ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, সেগুলি শুধুই জল্পনা-কল্পনা?

হ্যাঁ, ভালো করে খতিয়ে দেখলে বুঝা যাবে, সবকিছুর পেছনে কিছু না কিছু কার্যকারণ আছে। ভূত স্রেফ কল্পনাপ্রবণ মনের আদুরে বিলাসিতা।

আচ্ছা, আপনার জীবনে কি কোনো ভৌতিক কিংবা অলৌকিক কিছু ঘটেছে?

টাইম ইজ টিকিং, ইয়াং লেডি! আর দুই মিনিট।

তাহলে দ্রুত বলেন। আমি বেশি সময় নিব না।

অনেস্টলি বললে, ভূতের দেখা আমি পাইনি এখনও। কিন্তু আমার কল্পনাটা আবার বড়োই বিস্তৃত। অসুবিধা হয় না। বরঞ্চ নিজের লেখা পড়ে বেশ বিস্ময়াভিভূতও হই মাঝেমধ্যে।

মানে বলছেন যে সবচে ভালো ভূতের গল্প আসে নিতান্ত ভূতে অবিশ্বাসীর কাছ থেকে? আপনার মতো একজন প্রথিতনামা লেখকের সৃষ্টি কিন্তু সেটাই নির্দেশ করছে।

আমার লেখার গুণ নিজে বিচার করতে পারি না! তবে, বলতে গেলে ব্যাপারটা সেরকমই। হাহাহা।

আচ্ছা, স্যার আর বেশি সময় নিব না। সময়ও নেই আমার! ক্লিক করে ছোট্টো রেকর্ডারটা বন্ধ করে অধ্যাপক আহমেদের হাতে দিয়ে দিলো অনসূয়া।

এটা তো আপনার রাখার কথা! আমাকে দিচ্ছেন কেন? অবাক হয়ে গেলেন আহমেদ।

স্যার, আপনার নিশানটা বোধহয় রাস্তার ওপারে। দেখুন তো একটু?

আহমেদ সেদিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওটাই আমার!

তারপর পাশ ফিরে আরও কিছু বলার জন্য ফিরে দেখলেন, অনসূয়া নেই। আজব ব্যাপার তো! কিছু না বলেই চলে গেল! বিদায় বলার সংস্কৃতি বোধহয় উঠে যাচ্ছে এখন। এমনই ঝপ করে আসে, ঝপ করে যায়। কী একটা অদ্ভুত জেনরেশন!

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আহমেদ আর দাঁড়ালেন না।

গাড়িতে বসেই একটা কল পেলেন সাপ্তাহিক রোমাঞ্চের সম্পাদকের কাছ থেকে। খবরটা শুনেই প্রচণ্ড ধাক্কায় বিহ্বল হয়ে গেলেন অধ্যাপক আহমেদ হাসিব। রহস্য বিষয়ক রিপোর্টার অনসূয়া আবেদীন সাক্ষাৎকার নেবার জন্য বের হয়ে গুরুতর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সৌজন্যবশত তাঁকে খবরটা জানালেন।

এই বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে একবারও অদ্ভুত অব্যাখ্যেয় কিছু ঘটেনি তাঁর জীবনে। তবুও নিরন্তর লিখে গেছেন কল্পনার জাল বুনে। আজ একটি ঘটনা সব ওলটপালট করে দিলো। এতক্ষণ কাকে সাক্ষাৎকার দিলেন তিনি? গায়ে একেবারে কাঁটা দিয়ে উঠল।

আহমেদ হাসিব সেই যে লেখা ছেড়েছেন, আর কোনোদিন কিছু লিখেননি। তবে, এখনও মাঝেমধ্যে রেকর্ডকৃত আলাপটা শোনেন তিনি। মেয়েটি তাঁকে এভাবে জব্দ করে চলে যাবে, ভাবতেও পারেননি কখনও! মেয়েটির জন্য একটা অদ্ভুত ভালোবাসা লালন করতে থাকেন তিনি।

4 thoughts on “সাক্ষাৎকার

Leave a comment