এখানটায় একটু বসতে পারি?
প্রশ্নটা শুনে বিজনবাবু বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।
এটা পার্কের পাবলিক বেঞ্চ। সবারই বসার অধিকার আছে। আমাকে অহেতুক জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? ইতোমধ্যে বিজন শীলের ভ্রুটা কুঁচকে গেছে।
তাতে অবশ্য আগুন্তুকের কোনো ভাবান্তর হলো না। একগাল হেসে ফেললেন।
স্যার মনে হয় বেশি কথা পছন্দ করেন না? ভদ্রতা করেই জিজ্ঞেস করেছি। আজকাল ভদ্রতা কিংবা সম্মান কেউ করে না, তাই না?
তা করবে না কেন? খুব করে। বামপাশেই তাকিয়ে দেখেন। লীলা চলছে, লীলা।
মধ্যদুপুরে একটা ঝোঁপের ফাঁকে কলেজ পালানো দুই তরুণ-তরুনী বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গ হয়ে বুঁদ হয়ে আছে একে অপরে। আশেপাশে কে দেখছে কোনো ভাবান্তরই নেই, লজ্জাও নেই!
সেদিকে তাকিয়ে আবারও হেসে ফেলল আগুন্তুক।
ওদিকে না তাকালেই হয়। আপনি দেখছেন কেন?
আমি দেখছি কেন? পোড়াচোখ এখনও সবই দেখে। আচ্ছা, নাই দেখলাম। কানে তো আর খাটো হয়ে যাইনি। রিটায়ার করেছি কিন্তু সব ইন্দ্রিয় তো দান করে দিইনি!
স্যার খুব সুন্দর কথা বলেন। কী পড়াতেন? বাংলা?
এই যে তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছেন, আপনি কে বলেন তো? বিজন শীল মোটা বাইফোকালের ভেতর দিয়ে উৎসুক মুখে চেয়ে থাকেন। আমার প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ নয়তো?
কেন, স্মৃতি কি ক্ষয়ে গেছে? ইন্দ্রিয় তো সব ঠিক আছে শুনলাম। হাহা।
দেখেন, এমনিতে আমার মেজাজ ভালো নেই আজকে। বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে বসে আছি এই জঘন্য প্রেমমঞ্চে। আমার সাথে মশকরা না করলেই খুশি হবো।
মাফ করবেন যদি মশকরার মতো শোনায় আমার কথা! আচ্ছা, ত্রিশ বছর আগে একটা দুপুর মনে করিয়ে দিই। তখন করিমগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলাই পড়াতেন। বছর দশেকের একটি ছেলে বাংলায় বড়ো কাঁচা ছিল। সে পড়তে আসত আপনার কাছে। আপনি তার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অনুরক্ত শব্দটার সঠিক প্রয়োগ হয়েছে তো, স্যার?
কে, কে আপনি?
তারপর একদিন সুযোগ বুঝে এমনি চৈত্রের কোনো এক দুপুরে আপনি তাকে জবরদস্তি করলেন।
এই, আপনি থামবেন? কীসব বকতে লেগেছেন? কে আপনি? চেঁচিয়ে ওঠেন বিজন শীল।
চেঁচাবেন না। কাহিনিটা শোনেন আগে। তারপর যুবক বিজন শীল বড়ো ঘাবড়ে গেল। ভয়ার্ত শিশুটিকে দেখে নিজের অনিবার্য পতন দেখতে পেলেন। অতঃপর দুহাতের জোর দেখালেন কচি গলার চারপাশে। জংগলের গভীরে পরিত্যক্ত কুয়ায় ফেলে দেবার আগে বিস্ফারিত চোখের ভাষাটা কি মনে পড়ে, স্যার?
কে, কে তুমি? তপন?
আমি কে সেটা ব্যাপার না! আপনাকে শুধু মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। খুব ভালো। স্মৃতিতে এখনও মরচে ধরেনি তাহলে?
বাবা তপন! আমাকে ক্ষমা করে দে, বাবা! আমার ভুল হয়েছিল। হাতজোড় করেন বিজন।
ক্ষমা? খুব সহজ না, স্যার? আমি চাইলেই আপনাকে চরম শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু সেটা করব না। আপনাকে গুরুপাপে লঘুদণ্ডই দিলাম। যান, লঘুদণ্ডই নিন। বিদায়!
পরের যা ঘটল তা স্রেফ ইতিহাস। আজকের টিকটক প্রজন্ম লুফে নিল দৃশ্যটা। ঘন্টায় লাখ ছাড়িয়ে গেল শেয়ার।
শহরের একমাত্র পার্কে মধ্য দুপুরে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে কিছু অত্যন্ত আপত্তিজনক কুরুচিপূর্ণ যৌন ভঙ্গীমায় দেখা গেল। বুড়োটা শূন্যের সাথে বেকুবের মতো কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে!
বিজন শীল সজ্ঞানেই সব করছেন। বেশ বুঝতে পারছেন কী করছেন, কিন্তু তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই! অন্যভুবনের কেউ যেন নিদারুণ রোষে সব করিয়ে নিচ্ছে।
বিজনের মনে হলো এর থেকে মৃত্যুই ভালো ছিল!