যতীনের একটা ইলিশ খাবার বড়ো শখ হয়েছে। তেলেতুলে একাকার আবার ডিমভরাও হতে হবে। রুপার মতো চকচকে ইলিশের চার আনা সাইজের আঁশগুলো বুড়ো আঙ্গুলের নখ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলবে। মালতীর হাত থেকে আঁশবটিটা কেড়ে নিয়ে নিজেই পাখনা, লেজ আর মাথাটা কাটবে। ইলিশের মনকাড়া সুগন্ধী রক্তে রাঙা হাত একটু শুঁকেও নিলো সে এক ফাঁকে। মালতীর রান্নার হাত বড়ো ভালো। কিন্তু এই চ্যাপ্টা পাকা ইলিশটা সে নিজেই রাঁধবে। মাঝেমধ্যে খুব ভাবে থাকলে সে এই কাজটা করে।
এই যে হারামজাদা যতীন, এই গুঁড়ি গুঁড়ি বিষ্টিতে পথের মাঝে দাঁড়ায় থাকলে হবে? একটা মাছ টানতেই ক্লান্ত হয়ে গেলি? খেঁকিয়ে উঠলেন রহমত শেখ।
গম চুরির পবিত্র টাকায় শেখের ব্যাটা বিরাট হোমড়া-চোমড়া লোক। বাজারের সবচে বড়ো ইলিশটা তিনিই কিনেছেন। আর দেখিয়ে দেখিয়ে নেওয়ার জন্য ভাড়া করেছেন তাঁর গুদামের বস্তাটানা নিয়মিত মজুর যতীনকে। কিন্তু খেলাটা জমছে না ভালো। শালা থেকে থেকেই তাল হারাচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে খালি মিটিমিটি হাসে চোখ বন্ধ রেখে।
এ নিয়ে তিনবার এমন হলো। কোথায় উৎসুক জনতার মৎসজনিত প্রশ্নের জবাব যতীন দিবে তা না, ভাবুকসম্রাটের জন্য দুইবার তাঁকেই বলতে হলো। ভিতরে ভিতরে ম্যালা চটে গেলেন।
চারবারের বেলায় ধৈর্যচ্যুতি হলো। বাদলার দিনে এমনিতেই আলো মরে এসেছে অনেক আগে। ছাতা আর মাছসহ যতীন যথারীতি চোখ বুজে মিটিমিটি হাসছে। কাছে এসে কষে একটা লাথি ঝেড়ে দিলেন।
ছাতাটা ছিটকে পড়ল সাথে মহার্ঘ ইলিশটাও। রাস্তার কাদায় উল্টে যতীন মাখামাখি হয়ে গেল। দৃশ্যটায় বহুক্ষণের জমানো রাগ উপশমের মলম খুঁজে পেল যেন রহমত শেখ।
কিন্তু যতীন নির্বিকার উঠে দাঁড়াল। মুখের মিটিমিটি হাসিটা একটুও নিভেনি।
বাজান, লাত্থি দিলেন ক্যান? ভুইল্যা যাইয়েন না হাজার হইলেও আমি আপনার পোলা!
কী, কী কইলি তুই? তোর জিভ টাইন্যা ছিঁড়্যা ফেলমু!
আহা, রাগ করেন ক্যান? কাছে এসে মনে মনে দেখা ইলিশটার মতো রহমতের গায়ে হাত বুলাতে থাকে যতীন।
একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হতে থাকে রহমত শেখের। কোনো এক অব্যখ্যেয় কারণে তিনি আর কোনো খিস্তি করতে পারছেন না। পেট আর পিঠটা কেন জানি সুড়সুড় করে উঠল। হালকা চাকা চাকা পুরো শরীর জুড়ে। নিজের শরীরের বেলিফুল আতরের তীব্র গন্ধ ছাপিয়ে একটা হালকা আঁশটে গন্ধ নাকে এসে ঘাঁই মারতে থাকল। যতীন সেরকমই ঘোরলাগা মিটিমিটি হাসি চালিয়ে গেল।
গভীর রাতে দুইদুইটা ইলিশ পেয়ে যারপরনাই আহলাদে গলে গেল যতীনের বউ মালতী। একটা ছোটো আর একটা বিরাট সাইজের। গায়ে চার আনা সাইজের আঁশ। ওটার মুখে আবার একটা সোনার চেন লাগানো।
তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে যতীনের মুখে একটা ঠোনা মেরে বলল, মরণ আমার, যতীন শেখের মাথা ঠিক আছে নি?
খুব অন্তরঙ্গ ভাবে থাকলে মালতী যতীনকে যতীন শেখ বলে ফেলে মাঝেমধ্যে।