গল্পগুলি গাঁজাখুরি!

পিতা : কাপুচিনো

সকালে কাপুচিনো খেয়েছিল মুনিয়া। সে থেকেই তার পেটটা গর্ভবতীদের মতো বড়ো হতে থাকল। সকালে কাপুচিনো ছাড়া আর কিছু খায়নি সে। প্রচন্ড বিবমিষা। বিকেল হতে হতেই সে স্পষ্ট নড়াচড়া টের পেল। কে জানি একটা লাথিও মারল ভেতর থেকে।  মুনিয়ার পার্টনার চুন্নু একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। একসঙ্গে থাকার চুক্তিবলে চুন্নুর দ্বিমত করা বারণ। হাল সমাজে এমনই চলছে। চুন্নু মাথা দুলিয়ে বলতে থাকল, অবশ্যই কাপুচিনো খেয়েই তুমি গর্ভবতী হয়ে গেছ। এই সংবাদ সে বাইফাইতে (বায়ো ওয়াইফাই) দিয়ে দিলো। চুন্নু একজন প্রতিষ্ঠিত মূর্খ তার্কিক। তাই অন্য সবাই বলামাত্রই মেনে নিল। এই একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে কারও বিশেষ কোনো মাথাব্যথা নেই। বাইজেনরা (বাইফাই এর বিদগ্ধ তালমার* সমাজ) সবাই অতি দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল যে নিশ্চিত ভাবে কাপুচিনোটাই অনাগত সন্তানের পিতা। ২০০০ : ১০ ভোটে তা সাদরে গৃহীত হলো। বিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভোটটা দিয়েছেন গন্ডমূর্খ উপাধিধারী প্রফেসর জগলু। বহু বছর আগে মগজের ফ্রন্টাল লোবের ঐতিহাসিক আরোপিত পরিবর্তন প্রমাণ করে তিনি হাসির পাত্র হয়েছেন। সিরামটা তাঁরই তৈরি। পুরো প্রক্রিয়াটাকে নয় ঘন্টার মধ্যে এনে ফেলেছেন। অথচ গর্দভগুলোর সেটা বুঝার ক্ষমতাই নেই। যুক্তি আর সমালোচনা এখন কাউকে করতে দেখা যায় না। তবে এই খেলাটায় তিনি বড্ড আনন্দ পান। এখন যেমন জংগলের মতো গোঁফের তল দিয়ে হাসতে হাসতে বিড়বিড় করে বলছেন – হ্যাঁ, কাপুচিনোটাই তোমার সব্বনাশ করেছে!

*তালমার সম্প্রদায় – যারা তেল মেরেও তালগাছটি আমার তত্ত্বে প্রাণপাত করে বিশ্বাসী।

প্রকৃতির ডাক

বিমানের আসনে বসামাত্রই মবিন মিয়ার পেটটা মুচড়ে উঠল। বিয়ানে সোয়াকেজি উঠানের ধারে আধাপাকা টাট্টিখানায় দিয়ে এসেছিল। এখন তো লাগার কথা না। তারপর ম্যালা কাঠখড় পুড়িয়ে বিমানে উঠেছে। মুসা মিয়া বাপেরে উঠায় দিয়েই চম্পট মেরেছে। মবিন মিয়া প্লেনের বামও বুঝে না, ডানও না! দরদর করে ঘামছে। বায়ুর নিম্নচাপ ছোটোবেলায় দেখা সাইক্লোনের তান্ডবের মতো ঠেকছে। আর পারল না সে। চটের থলে থেকে প্লাস্টিকের লাল বদনাটা বের করল। এদিকওদিক তাকিয়ে নিমেষে প্লেনের দরজাটা খুলে বাইরে গেল মবিন মিয়া প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। সবাই হায় হায় করে উঠল। এই ডাক যে একবার শোনে সে কি আর উপেক্ষা করতে পারে? খালি ত্যাগের আশায় শুধুই ঘামতে থাকে।

ছাগী

ক্যামডেন মার্কেটে বেশ কয়েকটা পুরোনো জিনিসের দোকান আছে। পার্থ জেনিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। জেনি নাকি কোনোদিন এখানে আসেনি। মেয়েবন্ধুর আবদার ফেলা দুঃসাধ্য! জেনির সবই ভালো কিন্তু অত্যন্ত ন্যাকামি করে। এত বিরক্ত লাগে মাঝেমধ্যে। এই এখন যেমন ইজিপসিয়ান ধাপ্পাবাজটার হাতে সিল খাচ্ছে। সাধারণ একটা আংটি উচ্চমূল্যে কিনে দিতে হলো। অতঃপর বেশ পুরোনো জিনিসে ঠাসা একটা নিরিবিলি আফ্রিকান দোকানে ঢোকা হলো। বেশি খদ্দের নেই! জেনি স্বভাবসুলভ আহ্লাদি করে এটা ধরে তো ওটা ছাড়ে। পুরো দোকান একেবারে তছনছ করে দেবার জোগাড়। একবার বহুমূল্য একটা শোপিস ফেলেই দিয়েছিল প্রায়। মোটামতো বৃদ্ধা দোকানি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে যেন এখনই ভস্ম করে দেবে। পার্থ গিয়ে সেই আগুনে লাইন অভ সাইট ভন্ডুল করে দিলো। হাজার হোক তার বান্ধবীকে সেই বুড়ির রোষানলে পড়তে দিতে পারে না।

এমন সময় জেনি চেঁচিয়ে উঠল। সে একটা ছাগীর মুখোশ পেয়েছে। সেটা সে পরে দেখতে চায়। মুখোশটার দিকে তাকিয়েই পার্থ নাক-মুখ কুঁচকে হেসে ফেলল। অত্যন্ত জীবন্ত যেন এখনই ম্যাহ করে উঠবে। মুখোশটা ধরামাত্রই বুড়ি তেড়েফুঁড়ে এলো। একগাদা সতর্কবাণীতে যা বুঝা গেল – সব জিনিস সবার জন্য নয়! জেনির এটা পরা যাবে না। সে বারবার একই কথা ভাঙা রেকর্ডের মতো বলতে থাকল।

কুসংস্কার পার্থ মোটেই মানে না। জেনিও না। বিত্তবান ঘরের আদুরী ভাবল দোকানি বিরক্ত হয়েই ভালো জিনিসটা ওকে দিতে চাচ্ছে না। সে যা চেয়েছে, বরাবর তা-ই পেয়ে এসেছে। ঐ ছাগীর মুখোশ তার চাই চাই-ই! পার্থ কিছুক্ষণ বুঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। ম্যালা বাকবিতণ্ডার পর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বৃদ্ধা রাজী হলো। ভাবখানা এরকম – মারা খেতে চাইলে খাও গিয়ে। আমার কী!

রাস্তায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করল পার্থ। কোন্‌ ফাঁকে জেনি যে মুখোশটা পরে নিয়েছে, খেয়ালই করেনি। মুখোশটা বেশ ভালোভাবে সেঁটে গিয়েছে জেনির মুখে। একটু বেশিই নিঁখুতভাবে। কলকল করে একটানা আগামাথাহীন কথা বলে যাচ্ছে জেনি। তাকে যে একটা আস্ত ছাগীর মতো দেখা যাচ্ছে এটা যেন সে খেয়ালই করছে না। অজানা আশংকায় বুকটা ধ্বক করে উঠল।

ছয়মাস পরের কথা। মানুষের নানান পোষ্য প্রাণির প্রীতির কথা শোনা যায়। কিন্তু একটা অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে কেউ একটা দুগ্ধবতী ছাগী পুষতে পারে, এ নিয়ে পার্থর প্রতিবেশীদের বিরাট কানাঘুষা। ওঃ, জেনি নামের আহ্লাদী মেয়েটাকে আর কোথাও দেখছে না কেউ! পার্থর কোলে থাকা ছাগীটা ম্যাহ্যাহ্যা করে উঠল।

কাকেদের একদিন

ঘন বরষার সন্ধ্যায় পাড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই শান্ত একটা কাক হয়ে গেল। কীভাবে এই রুপান্তর হলো, বুঝা গেল না। কেউ দেখতে পেয়েছিল কিনা তাও জানে না। অবশ্য অমন ঝুম বৃষ্টিতে নিমেষে জমে যাওয়া হাঁটু পানিতে একমাত্র শান্তর মতো আধাপাগলই সান্ধ্যভ্রমণে বের হবে। কিন্তু এত পাখি থাকতে কাকই কেন হতে হলো তাকে? কাকপক্ষীটাকে তার খুবই অপছন্দ। কেমন কুতকুতে চোখে তাকিয়ে থাকে। স্পষ্ট অনুভূতি হয় যেন পর্যবেক্ষণ করছে। এই কদিন আগেও গুলতি দিয়ে একটাকে লাশ বানিয়ে দিয়েছিল। যদিও ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে আরকি!

কাক তো হওয়া গেল, কিন্তু এই প্রবল বর্ষণে ভেজা কাক হয়ে থাকা ভালো ঠেকল না ওর। পাখা ঝাপটিয়ে বরই গাছের ডালে গিয়ে বসল। উড়তে বেশ লাগছে কিন্তু এই বৃষ্টিটা অসহ্য হয়ে গেল। একটু উষ্ণতা দরকার। সে তার কাকচক্ষু দিয়ে কোনো একটা পাখির বাসায় আতিথ্য গ্রহণের অভিপ্রায়ে ইতিউতি তাকাতে লাগল। বরইয়ের ঘন পাতা ভেদ করে কাছেই একটা বাসা দেখতে পেল। সেটা যে আরেকটা কাকের বাসা, এ সে কী করে বুঝল, কে জানে?

পুরুষ পাখিটি এগিয়ে এল। সাথে চোয়াড়ে চেহারার আরও দুটি কমবয়সী পাখি। অজানা কারণে ব্যাপারটা ভালো ঠেকল না শান্তর।

আপনাকে স্বাগতম যদিও আমরা আপনাকে চিনতে পেরেছি। কাকেদের নিয়ম অনুসারে আমরা আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি রাখব না। কিন্তু আপনাকে ছাড়বও না। শেষের বাক্যটি চোয়াড়ে চেহারার বাচ্চা কাকগুলি সমস্বরে বলল। শুনে শান্তর কাকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মানে কী এর?

গুরুতর জখম হয়ে বরইয়ের ডাল থেকে পড়ে যাওয়াটা শান্ত নিমেষের মধ্যে দেখে ফেলেছিল। কিন্তু শেষ দুঘন্টায় যা চলছে তা অবিশ্বাস্য! শুকনো বরই পাতার আরামদায়ক কুশনে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। চোয়াড়েদের একটা কোত্থেকে দুটো জোনাক ধরে শান্তর তাকিয়ার সামনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তরতাজা কতগুলো কেঁচো খেতে দিয়েছে। কেঁচোটা গিলতে গিলতে শান্ত মনে মনে বলে উঠল, জীবন হয় সুন্দর!

তিনটি কাকই বিন্যাস আর সমাবেশ করে কা কা করে উঠল। যার মানে দাঁড়ায়, আমাদের পুরোপুরি জেন্টস ক্লাব করে ফেললেও আমরা কৃতজ্ঞ! ঘষেটি বেগম আমাদের জীবন জ্বালিয়ে খেয়েছিল। আয়েসে পাখা নড়াতে নড়াতে শান্তর মনে হলো গুলতি দিয়ে মেরে ফেলা কাকটা মহিলা ছিল সম্ভবত।

মাছি

মাছি মারতে গিয়ে একটা আস্ত মাছিই গিলে ফেলল রন্টু। এমন নয় যে সে হাঁ করে ছিল। একটা নীল মোটাসোটা মাছি চোখের সামনে ঠোঁটের ভাঁজ খুলে ঢুকে গেল। প্রাণিসমাজে আত্মহত্যার কথা অজানা নয় তবে একটা মাছি এরকম করবে তা অন্তত রন্টু ভাবতে পারেনি। মাছিটা গেলার পর রন্টুর আম খাওয়াটা লাটে উঠার কথা কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। বরং রমিজুন বিবি আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। তাঁর আমে অরুচি ছেলে নিজে থেকে দুটো আম চেয়ে নিল। এ খুশি তিনি কই রাখবেন?

আম-ঘুমে রন্টু দারুণ মত্ত। ফুলি ঘরের কাজ শেষে স্বামীর পাশে মাত্র শুয়েছে। এই ভরা দুপুরের নিরিবিলিতে একটু আদরসোহাগ সে চাইতেই পারে। সে রন্টুকে একটা মৃদু গুঁতো দিলো। সংকেত আরকি! রন্টু অভ্যাসবশেই একহাতে ফুলিকে টেনে বুকের উপর ফেলল কিন্তু তার ঘুম ভাঙে না। ঠোঁট ফুলায় রন্টুর অষ্টাদশী বউ। অভিমানে বুকের উপর কান পেতে দেয়।

মাছির একটানা ভনভন কারও অজানা থাকার কথা না। লোকটার বুক এবং নাক থেকে অবিকল সেই শব্দই আসছে।

বিকেলে হাঁটে গেল রন্টু আর তার ছোটো ভাই মন্টু। মাথায় এক ঝাঁকা আম। প্রচুর আম হয়েছে এবার। ভালো বিক্রির আশায় ফুলির জন্য একটা লাল ছাপা শাড়িও দেখে ফেলল সে। দিনের আলো কমে আসছে। মাগরিবের আজান পড়ে গেল। ঝট করে দাঁড়িয়ে রন্টুর মনে হলো সে কিছুই ভালো দেখতে পারছে না। দুহাতে চোখ কচলাল ভালো করে। সবই ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হচ্ছে। অবস্থা আরও খারাপ হবার আগে সে চিৎকার করে ডাকল, মন্টু আমারে বাড়ি নিয়া চল।

রমিজুন আর ফুলি বিবি দুজনেই সুর করে কাঁদছে। লেপা উঠানের মাঝখানে চিকন সুরের কান্নার রাগিনী ভেদ করে পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে চিন্তা করে দেখতে চাইল রন্টু। কিন্তু খুব অলসতায় পেয়ে বসেছে। ঝিমঝিমে ঘুমঘুম ভাব। এরই মাঝে ত্যক্ত করছে মতিন মুন্সি। অনবরত কীসব পড়ে যাচ্ছে, রন্টু ঝিমুনিতে কিছুই ঠাহর করতে পারল না। রাত বাড়লে মতিন তাঁর হাদিয়া নিয়ে পাট গুটালো বটে কিন্তু রন্টুর তেমন পরিবর্তন হলো না। পাকঘরের পাশে ঝুপড়ি লেবুগাছের পাতার নিচে জড়সড় হয়ে তাকে বসে থাকতে দেখে ফুলির কেমন ভয়ভয় করতে লাগল। ‘মানুষটা কি পাগল হয়া গেল?’

সবচে বড়ো অঘটনটা হলো এক্কেবারে কাঁচা বিয়ানবেলায়।  

গাইটাকে খড় আর পানি দিয়ে লাউয়ের মাচান থেকে শাক ছিঁড়তে গিয়ে আম বাগানের দিকে চোখ গেল ফুলির। প্রত্যন্ত গ্রামে বাগানের মধ্যে প্রকৃতির ডাক সারা সাধারণ বিষয়। ব্যাপার সেটা না। এই ভোরে ওখানে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মন্ডলের পো। সদ্য নিঃসৃত ধোঁয়া ওঠা হলুদাভ মানব বর্জ্য বিভোর হয়ে শুঁকছে রন্টু মন্ডল। ফুলি বিবি ওখানেই মূর্ছা গেল।  

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s