ছোট গল্প: পুনর্ভব

প্রায় প্রতিদিনই তো রাত করে আমায় ফিরতে হয়। মধ্যরাতের শেষ বাসটিকে বিদায় জানিয়ে মিনিট পনেরোর পথ হাঁটছিলাম। জনবিরল রাস্তা; দু’এক জন পথচারি থাকেই তো। অথচ সেদিন কাউকে পেলাম না, আশ্চর্য! বাতিগুলোকে একটু ম্লান মনে হচ্ছে…কিন্তু তাই বা হয় কী করে? এবারে চোখটা দেখাতেই হবে আর কী ভেবে ভেবে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ মাটি ফুঁড়েই যেন একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। বুকটা অজানা কোনো একটা অস্থিরতা কাটিয়ে উঠে যেন স্বস্তি খুঁজতে চাইল। শীতের নিশুতি রাত; আপাদমস্তক গরম কাপড়ে মোড়া বলে ঠিক বুঝলাম না আমার কোনো প্রতিবেশি কিনা। আমি যেদিকে হাঁটছি ঠিক সেদিকেই যাচ্ছে। বাহ্‌! ভালোই হলো ভাবলাম। তখনো জানতাম না কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

হাঁটতে হাঁটতেই দেখলাম আমার সঙ্গী পথচারিটি দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনছে। মনে হচ্ছে হাঁটার প্রতিযোগিতা বুঝি! আমিও কী মনে করে একটু গতি বাড়িয়ে দিলাম। চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম: তারও গতি বেড়েছে। এহে! এই রাতবিরেতে খেলতে চাও? ঠিক আছে, আমিও নাছোড়বান্দা। দ্রুত পা চালালাম…এখন প্রায় ছুটছি…সেও ছুটছে। তখনি ভুলটা করে ফেললাম-ডানে মোড়টা না নিয়ে সোজা যেদিকে পরিত্যক্ত একটা ইস্কুল আছে সেদিকে পা বাড়ালাম। মিনিট পাঁচেক ছোটার পর হুঁশ ফিরে এল-আমি এদিকে কেন? আজব! চারপাশে তাকাতেই গা হিম হয়ে গেলো। প্রায় বিশ গজ দূরে ‘সে’ ও দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক একি ভঙ্গি-আপাদ-মস্তক আমার কাপড়ে মোড়া, আমার চোখজোড়া যেন সেখানে বসানো, চশমাটাও আমারি…ঠান্ডার মধ্যেও একটা ঘামের বিন্দু শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে চাইছে। এ যে আমিই …শুধু তার মুখে লেগে থাকা একখানা ক্রুর হাসি ছাড়া। এমন আতান্তরে কখনো পড়িনি; পায়ের নীচে ক্ষয়াটে ধূসর মাঠ যেন দুলে উঠলো। চোখটা একটু বুজতেই যেন অতীতের কিছু দৃশ্য শাঁ শাঁ উড়ে গেল…এই একি মাঠ, ভয়ার্ত একটা মানুষের মুখ…ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ…অস্তিত্বের দখলদারিত্বে হেরে যেতে থাকা বিবর্ণ একটা সত্তা। আচমকা সব মনে পড়ে গেলো…অজানা থেকে এসেছিলাম…কৌতুহলে মানুষ হতে চেয়েছিলাম। অজান্তে শিকার করেছিলাম উদাসীন একটা মন কে। কে জানত তার বুকে এতটা কষ্ট ছিল! এ ক’টা দিন তাঁর মতই হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এতটা গভীর ক্ষত শুধু মানুষই বয়ে বেড়াতে পারে। বুঝতেই পারিনি ধীরে ধীরে পরাজিত হচ্ছিলাম! ঝুঁকে পড়া সেই আগুন্তকের ক্রুর হাসিটা হটাৎ কোমল হয়ে যায়! নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে ক্ষমা করে দেয় বুঝি। মানুষই বুঝি পারে এতটা দুর্বোধ্য হতে! এরপর আর কিছু মনে নেই আমার!

☼☼☼☼☼☼

ইস্কুলের মাঠে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম! বন্ধ হাতঘড়ির রেডিয়াম আলোয় তারিখটা দেখে আঁতকে উঠলাম! ইয়া আল্লাহ! ছয়মাস সাতদিন কোথা দিয়ে গেলো! কিছুই বুঝতে পারছি না। ধুলো ঝেড়ে দিক ঠিক করে হাঁটতে থাকলাম। একটা অন্য রকম বিষাদে মনটা ভরে আছে। কিন্তু কেন? মন বলছে সব জানি, কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না! আশ্চর্য!!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s