১.
মিলার মনটা বেশ খারাপ। শিহাব গত রাতেও ফেরে নি। এখন এরকম প্রায়ই হচ্ছে। হুট করে ফোন করে বলে কাজে আটকে গেছে। শিহাবকে চাকরি সূত্রে মাঝে মাঝেই এই শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতেও কি চাকরি থাকে? জিজ্ঞেস করলেই আগডুম বাগডুম একটা বুঝিয়ে দেয়। মিলা কি সেসব বোঝে না? সে সবই বোঝে। অনাদর কিংবা উপেক্ষাটা চাপা থাকছে না ইদানীং। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। কী লাভ?
চমৎকার সাজানো বেডরুমের শূন্য কিং সাইজ বিছানাটা কি একধরণের নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নয়? মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রে একা শুয়ে আছে! আজকের সকালটাও কেমন কেমন যেন। থমথমে মুখের মেঘেদের নিয়ে গোপন কোনো অভিমানে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। জানালা দিয়ে টুকরো বিষন্ন আকাশটা দেখে এসবই ভাবছিলো মিলা। এই দু’বছরে বেডখানা কেবল উপহাসই করে গেলো!
বেলা একটু একটু ধীর পায়ে বাড়ছে। ছুটির দিনে উঠতে ইচ্ছে করছে না। উঠে করবেইটা কী? শিহাব নেই তো নাস্তা করবে কার জন্য? নিজের জন্য কোনোদিনই ভাবনা থাকে না মিলার। যাহোক একটা কিছুতে বরাবরই সন্তুষ্ট থেকে এসেছে। নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কখনো উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেনি কেউ তাকে। তাই যখন শিহাবের সাথে সম্বন্ধটা এলো, রাজী হয়ে গেলো এক রকম। যোগ্য ছেলে। মাল্টি ন্যাশনালে ভালো চাকরি করে। যদিও বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশিই ছিলো। কিন্তু কেউ গা করলো না! তবে গোপনে কি বুকটা ভিজেছে একটু? রঞ্জুকে কি ভালোবেসেছিলো ও? তবে সেও তো এক তরফাই ছিলো। ঐ যে নিজের কোনো ব্যাপারই গা করে না। ঐটিও এক প্রকারের একটা অপ্রকাশ্য গল্পের মত হয়ে থাকলো!
এইসব গভীর ভাবনায় কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো মিলা। সম্বিৎ ফিরে পেলো ফোনের শব্দে। আলগোছে তুলে নিয়েছিলো তাই খেয়াল করে নি নাম্বারটা।
হ্যালো? কে বলছেন?
অলস ঝিমঝিমে গলায় শুধায় মিলা। ওপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো। বার কয়েক জিজ্ঞেস করেই কেটে দিলো। দেখতেও ইচ্ছে করলো কে করেছে। মরুক সব! আবার ভাবনাতে ডুবে যাবে অমনি আবার বেজে উঠলো। এবার নাম্বারটা দেখলো। রাগে গা জ্বলে গেলো। আবার সেই লোকটা…
ফোনটা বেজেই চলেছে। বাজতে বাজতে এক সময় থেমেই গেলো। ইচ্ছে করলেই মিউট করে রাখতে পারে। কিন্তু আজ কী যে হয়েছে… কেমন যেন উপেক্ষা ভাব সব কিছুতে। ফোনটা খানিক বিরতি নিয়ে আবার বেজে উঠলো। কী সুন্দর একটা রিংটোন সেট করেছিলো – বৃষ্টির একটানা ধারাপাতের শব্দ! সেটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। আবার কিছু বিরতিতে বেজে উঠলো। প্যাটার্নটা পরিচিত হয়ে গেছে। এ সে-ই হবে। আর কেউ নয়! আচ্ছা ছ্যাঁচোড় তো। না ধরা পর্যন্ত জ্বালাতেই থাকবে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে। কীভাবে নাম্বার যোগাড় করেছে, কে জানে? খুব একটা কথা বলে না। শুধু জিজ্ঞেস করে – ভালো আছেন? আর একটা গুড়গুড়ে হাসি। ব্যস এটুকুই। কখনোই জবাব দেয় না মিলা। এই সামান্য বিষয়টাকে পাত্তা দেবে না বলে ঠিক করেছিলো। তাই কাউকে জানায় নি। শিহাবকেও না। এ কি বলার মত কিছু? কিংবা হয়তোবা কিছু একটা কি আছে? আজকে হঠাত করে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। ঐ আবার বাজছে।
ফোনটা ধরলো মিলা। রাগত স্বরে – কেন জ্বালান আপনি? কথাও তো একটা বলেন না! শুধু জিজ্ঞেস করেন ভালো আছি কিনা! কী চান আপনি? ভালো নেই, আমি ভালো নেই! খুশি? গলা ধরে আসে মিলার।
ওপাশে এই প্রথম বারের মত কণ্ঠটা চিরাচরিত গৎবাঁধা প্রশ্নটা করলো না। হাসলোও না। একটু যেন বিচলিত! গমগমে ভরাট কণ্ঠে একটু কেশে – ভালো নেই? কেন?
মিলা ঝেঁঝে উঠে – সেটা আপনাকে কেন বলবো?
বলবেন না? তাহলে বলতে গেলেন কেন ভালো নেই?
আমার যা ইচ্ছা তা-ই করবো, আপনি কৈফিয়ত চাওয়ার কে, শুনি?
আমি কেউ না।
ঠিক, আপনি কেউ না। দয়া করে আর জ্বালাবেন না। রাখছি।
না, রাখবেন না, প্লীজ।
কেন রাখবো না?
কারণ আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন। একটা খুক করে হাসির শব্দ আসে। রাগ বাড়তে থাকে মিলার।
আপনি অন্তর্যামি, তাই না? আমাকে না চিনেই সব বুঝে ফেললেন।
চিনি না, কে বললো? আলবৎ চিনি।
চেনেন, আশ্চর্য! আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না। মিলার কন্ঠে খানিকটা উষ্মা।
কথা বলতে থাকেন। বলতে বলতেই চিনে যাবেন।
আমার অত চেনাজানায় কাজ নেই। বিরক্তিকর একটা! বলেই খুট করে কেটে দেয় মিলা।
২.
মনটা কি একটু খারাপ হয়ে গেলো? কে এই লোকটা? ওভাবে অভদ্রের মত না রেখে দিলেও তো চলতো। খারাপ তো কিছু বলে নি। জানতে চেয়েছে ভালো আছি কিনা। আশ্চর্যের ব্যাপার, কতদিন পর কেউ একজন সত্যিকারের উদ্বেগে জানতে চেয়েছে ভালো থাকা না থাকার কথা! প্রকৃত আবেগগুলো বুকের গভীরে কখনো ধোঁয়াশা হয়ে থাকে না – ঠিকই পদচ্ছাপ রেখে যায়। মিলা বেশ বুঝতে পারে ঐ জানতে চাওয়াটা কতখানি খাঁটি! উহ, কিছু ভালো লাগছে না। আজকের সকালটাই বড্ড গোলমেলে ঠেকছে!
ভাবনার জাল কাটিয়ে আবার সরব হয়ে ওঠে ফোনটা।
মিলার সাঁড়াশি আক্রমণ – আপনি এত নির্লজ্জ কেন? এভয়েড কথাটি কি আপনার ডিকশনারিতে নেই? না থাকলে এন্ট্রি করে নিন।
ও প্রান্তের কন্ঠটি দরাজ হেসে ওঠে – আমার মনে হচ্ছে না আপনি আমাকে এভয়েড করতে চাইছেন। তারপর সেই বুক ওলটপালট করা নরম কণ্ঠে – বললেন না, মন খারাপ কেন?
কী থেকে কী হয়ে যায় মিলার। ধরা গলাটায় এখন পষ্ট একটা চাপা ফোঁপানির শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো। শ্রোতার বিচলতা আরো বাড়ে।
জানেন, ও গতকালও বাড়ি ফেরে নি! এরকম হয়েই চলেছে। বাকীটুকু উদ্গত কান্নায় বলতেই পারে না।
কে বাড়ি ফেরে নি, শিহাব সাহেব? ফোনের রহস্যমানব আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করে।
আবার কে হবে? শিহাব এখন ছুটির দিনেও বাড়ি ফিরছে না। জানেন, আমি আর পারছি না। ও আমাকে ভালোবাসে না। মনে হয় কোনোদিনও বাসে নি!
একটা প্রায় অপরিচিত মানুষের কাছে কীভাবে অকপটে নিজের গোপন দুঃখের কথাগুলি অনায়াসে বলতে পারলো? মিলা বড় লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়লো। তখনি ব্যাপারটা মাথায় এলো।
আচ্ছা, আপনি শিহাবের নাম জানলেন কী করে? তার মানে ওর পরিচিত কেউ?
অপর প্রান্তে হাসির শব্দ – কী ছিঁচকাঁদুনে, এখন মাথা খুলছে নাকি? হা হা হা। পরিচিত হলেই জানবে। আর কোনোভাবে জানতে নেই? আমি তো আপনার নাম-ঠিকানাও জানি।
জানেন? ওঃ, কীসব বলছি! সব আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছেন দেখি!
মিলা!
আপনি কী চান, পরিষ্কার করে বলেন তো? খালি খালি হেঁয়ালি করেন। কী নাম আপনার? থাকেন কোথায়? খালি একটা কথাই ভাঙ্গা রেকর্ডের মত বলেন – ভালো আছেন? কী লাভ আপনার আমি ভালো আছি কিনা জেনে?
লাভ আছে, সে আপনি বুঝবেন না। ভালোবেসেছেন কখনো?
মিলার দম খানিকটা আটকে যায়। সত্যিই তো…সে ভালোবেসেছে কখনো? রঞ্জুর অগোছালো চুলের প্রায় বিস্মৃত মুখটা ভেসে ওঠে। একতরফা বেদনা। তবুও ভালোবাসা তো। কিন্তু নিজেকে বঞ্চিত করে সে সম্ভাবনার গলা সে তো নিজ হাতেই টিপে দিয়েছে। নিজেকে বড় প্রতারিত মনে হতে থাকে। কেন নিজেকে একটুকু পাত্তাও দিলো না এত কাল?
মিলা যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
কী, জবাব দেবেন না? ওপাশের নাছোড়বান্দা তাড়া দেয়।
ঘোর ভাঙ্গে মিলার – কী বলছিলেন যেন?
বলছিলাম, ভালো বেসেছেন কখনো…
সে আপনাকে কেন বলবো?
আবার সেই কথা! এই ছ’মাসে আমরা কি একটুও কাছে আসি নি? কাছের মানুষ হতে আর কী কী লাগে, মিলা?
সে আমি জানি না। তবে ভালো করেই বুঝছি, আপনাকে প্রশ্রয় দেয়া আমার মোটেই ঠিক হচ্ছে না। আমি বিবাহিতা.. এটা ঠিক নয়, মিস্টার এক্স…
অপরপ্রান্তে একটা সরল প্রাঞ্জল হাসি ভেসে আসে। সাথে একটু খুনসুটির ভাব।
ভয় পাচ্ছেন? প্রেম প্রেম মনে হচ্ছে? হা হা হা
অকারণ একটা লজ্জা পেয়ে যায় মিলা। আপনি তো ভারী ঠোঁটকাটা! কী সব যা-তা বলছেন?
যা-তা বলছি? আমার তো মনে হচ্ছে আপনার গাল দু’টো লাল হয়ে গেছে। গালের টোলটায়…
থাক, থাক অত বর্ণনায় কাজ নেই! ফোনে শব্দ শুনেই সব বুঝে ফেললেন। আপনি তো রীতিমত ফ্লার্ট করছেন!!
এতক্ষণে বুঝলেন? করলে ক্ষতি কী? বুকে হাত দিয়ে বলেন তো ভালোলাগছে না?
আমার বয়েই গেছে! খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই…অসভ্য কোথাকার!
আপনার কণ্ঠটা যে কত মিষ্টি, সে কি জানেন? বলতে গেলে সেই মধু শুনতেই তো হ্যাংলার মত খালি ডায়াল করি। না ধরা পর্যন্ত তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকি…
নাহ, আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে। কোথা থেকে কোথা যে চলে যাবেন। বেশ বিপজ্জনক লোক তো আপনি!
একটা কথা বলি, শুনবেন? গাঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করে ভরাট কণ্ঠ।
শুনছিই তো। বলেন…
ওপাশে খানিক নিস্তব্ধতা। একটা টান টান উত্তেজনার তির এসে যেন সময়ের ধনুকে আপনি জুড়ে যায়। তিরটা একটা কিছু বলবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। কিন্তু অতি সর্বনাশাও যেন চূড়ান্ত ক্ষণটির আগে কিছুটা বিমূঢ় হয়ে যায়। ভাষা হারিয়ে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে! শেষমেষ অপরিচিতের সেই ব্যাকুলতার কথাগুলো বলা হয়ে উঠে না। সুশীল সংকোচ!!
কী একটা বলতে যাবে অমনি কী করে জানি কিছু একটা বুঝে ফেলে মিলা। বলে – না, না থাক। কাজ নেই আর শুনে।
আহা, শুনেই দেখেন না? ভালোও তো লাগতে পারে।
না, না শুনবো না। এই ফোন সরিয়ে নিলাম।
অপরিচিত হাসতে থাকেন। আশ্চর্য মিলাও হাসতে থাকে। মনোভারের মেঘ কি কাটতে থাকে একটু একটু করে? মনের আকাশ ফর্সা হতে থাকে খুব ধীরে। সাথে জানালার বাইরে থমথমে আকাশটাও। মিলা দেখে মেঘ সরে গিয়ে নরম রোদ্দুর ঝিকিয়ে উঠছে। আচমকা বড় ভালো লাগতে থাকে।
আসেন, আজকে আপনাকে বেড়িয়ে আনি? কেমন হাসছে চারদিক, দেখেছেন?
মিলা কিছু না ভেবেই মুখ ফস্কে শিশুর সারল্যে বলে ফেলে – সত্যিই আসবেন?
পরক্ষণেই বিবেচনা ফিরে পায় যেন। না, না থাক। কিছু মনে করবেন না। সেটা ঠিক সংগত হবে না।
সে আমি বুঝলাম না আপাতত! আমি কিন্তু সত্যিই আপনার জন্য অপেক্ষা করবো… আসবেন মিলা?
না, না। সে হয় না। মিলা ক্ষীণস্বরে আপত্তি জানায়। তাতে অস্বীকার থেকে স্বীকারের পাল্লাই যেন হালকা একটু বেশি ভারী হয়ে থাকে। ওদিকের শ্রোতা ঠিকানা দিয়ে দেয়। একটা পার্ক। বেশি দূরে নয়। মিলাদের বাড়ি থেকে কাছেই। মিলা শুনবো না শুনবো করেও ঠিকই মনে রাখে। মন বড় আশ্চর্যের বস্তু!
ফোনটা একটা দুর্দম প্রতীক্ষার জোরালো প্রতিশ্রুতিতে কেটে যায়।
৩.
মিলা উঠে পড়ে। কি একটা তাড়া যেন বহুদিন বাদে ওকে নাড়া দেয়। বাথটাবের ঈষদুষ্ণ জলে ২৬ বসন্তের লতানো শরীরটা আলতো ডুবিয়ে রাখে। একটা অদ্ভুত পুলক গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নিজেকে নিয়ে ঠিক ক’বে এরকম ভেবেছিলো, মনে করতে পারলো না। আচ্ছা, সে কি যাবে নাকি? বড় চঞ্চল লাগে।
আবার এ-ও মনে হয়ঃ এই শিহাবের সাথে আরোপিত বন্ধনে সে কী পেয়েছে? শিহাব কেন যে ওকে ঘরে তুলেছে, এ এক আশ্চর্য বটে! বিগত দু’বছরে শিহাবের সাথে কোনো ধরণের এটাচমেন্টই গড়ে উঠলো না। শিহাব কোথায় রাত কাটায়, সেটা আঁচ করতে পারে মিলা। কেন এখন ছুটির দিনগুলোতেও ফিরছে না, এটা বের করাও কঠিন কিছু না। পুরোনো প্রেম ভোলা সহজ নয়। শিহাব ভুলতে পারে নাই। সবাই সব জানে। তবুও শিহাব ফোন করে জানায়। এই আঘাত দেয়ার মধ্যে সুখ পাবার মানসিকতাটা দেখে ঘৃণায় তেতে ওঠে মিলা।
মাঝে মাঝে বড্ড হতাশ লাগে। আজীবন নিজের প্রতি উদাসীন থেকে কী পেলো? অবিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী? টানহীন, ভালোবাসাহীন দাম্পত্য? একটা অনাদরের পোকায় খাওয়া তারে ঝুলছে ঘরের সুখস্বপ্ন! অথচ মিলার এটা কি প্রাপ্য ছিলো? সে তো আর দশটা মেয়ের মত একটা ঘরই বাঁধতে চেয়েছিলো। সেটা কি খুব বেশি চাওয়া ছিলো? আর ভাবতে পারে না মিলা। টাবের ফেনিল জলে নীরবে মিশতে থাকে অভিমানের অশ্রুজল। বুকের ভেতর জমে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।
অনেকদিন বাদে বড় যত্ন নিয়ে সাজছে মিলা। একটা লালপেঁড়ে শাড়ি মুগ্ধ বিস্ময়ে আপ্লুত নদীর মত ছুঁয়ে গেলো মিলার অঢেল সৌষ্ঠব। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়। অসামান্য স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি বাঁক ভাঁজ। আর একটা উপচানো প্রতীক্ষা… কার জন্য? কার জন্য আবার? নিজেই নিজেকে ধ্মকে ওঠে। আচ্ছা, কেমন হবে মানুষটা? যদি হতচ্ছাড়া দেখতে হয়ে থাকে? হলে হবে… সে তো কায়াহীন সত্তাটাকেই কাছে টেনেছে… বাকী ওসবে কী যায় আসে? তবুও এক নিষিদ্ধ আনন্দের মত উত্তেজনায় বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজতে থাকে চিবুকের খাঁজ, কপালের গুচ্ছ চুল।
স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে বেরোতে যাবে অমনি বেমক্কা একটা কল পেলো। না দেখে ধরেই জিজ্ঞেস করে – কে? আসছি, বেশিক্ষণ লাগবে না। অপেক্ষা করবেন কিন্তু! যেন নিশ্চিত সেই অচেনা যুবকেই করেছে!
কোথায় যাচ্ছো? বড় অবাক হয়ে যায় শিহাব।
থতমত খেলেও সামলে গেলো মিলা। বলে – ও, তুমি?
কাকে ভেবেছিলে? নাগর-টাগর জুটিয়ে ফেললে নাকি?
ভদ্র ভাষায় কথা বলো, শিহাব। সে শুধু তোমারই জায়গা তা-ই ভেবেছো, না?
মানে কী? স্পষ্ট করে বলো কোথায় যাচ্ছো?
তবে শোনো, একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তোমার মত শাক দিয়ে মাছ ঢাকছি না আমি। আমি ক্লান্ত, শিহাব। আর পারছি না। আমি মুক্তি চাই! হয়তো তুমিও চাও…
কথাগুলো অসত্য নয়। নরম মনের একটা মেয়ের থেকে কঠিন এই কথাগুলো শুনেও কিছু বলতে পারলো না। দোষ তো তারও কম নয়! এ তো হবারই ছিলো! লাইনটা আলগোছে কেটে গেলো।
রোদ চড়েছে বেশ। পার্কের গাছগুলো সবুজ পাতার নবযৌবন নিয়ে গর্বিত গ্রীবায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দৌঁড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, বাচ্চাকাচ্চার একটা দল হল্লা করছে পাশেই। রেশমি লোমে ঢাকা একটা কুকুর হাতে এক বৃদ্ধ আনমনে চলছিলো। মিলাকে দেখে একটা চোখ টিপে দিলো! কী অসভ্য!
এই রকম মানুষের মেলায় কী করে চিনবে সেই মানুষটাকে? সেই অতি অচেনার তবুও যেন কতকালের চেনা মানুষটাকে? আচ্ছা, ভালোবাসতে কত সময় লাগে? একটা সেইরকম পলই কি যথেষ্ট নয়? অদ্ভুত সেই সময়ে ততোধিক অদ্ভুত প্রতিবোধনের আলো এসে পড়লে যখন বুকের অস্বীকারি উদাসীন তারগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যেতে থাকে, তখনই প্রেম লাজুক আত্মপ্রকাশ করে। ভাবতে ভাবতেই এলোমেলো হাঁটতে থাকে মিলা। আজ বড় ভারহীন লাগতে থাকে। কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? কীভাবে? যদি খুঁজে না পায়? বুকটা ঢিবঢিব করতে থাকে। যদি সে কথা না রাখে। শুধু ফোনে ফোনেই এতদূর! হঠকারিতা কি হয়ে গেলো?
হলে হবে। হঠাত সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা শক্তি যেন ভেতরে ভেতরে টের পায়… নিজেকে নিয়ে ভাবে নি এতকাল। নিজেকে একটুও ভালোবাসে নি। সময় দেয় নি আজন্মের বঞ্চিত সেই দুঃখি মেয়েটাকে। মনে হচ্ছে আজ সেই সময় এসেছে। বেশি ভাববার কী আছে? আজ কিছুতেই খোলসে ঢুকে যাবে না!
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। এদিকে ওদিকে উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে এলো না। একটা ঘন্টা বেশি পেরিয়ে গেলো। আচ্ছা, হাতঘড়িটা ঠিক চলছে তো! নাহ, ঠিকই আছে তো! কাউকে কি জিজ্ঞেস করবে সময়টা? এই অধীরতাই কি প্রেম? প্রেম শব্দটা নিজের মনে আউড়ে হঠাত আরক্ত হয়ে যায়। কেমন স্বপ্নীল মনে হতে থাকে সবকিছু! এই কোলাহল, পুঁচকেদের ঝগড়া, বুড়োর চোখটিপি – সব, সব ভালোলাগে। বেভুল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখনি কে একটা এসে মিলার আঙ্গুল ধরে টান দিলো।
সম্বিৎ ফিরে দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে একহাতে একটা গাঢ় লাল গোলাপ আর অন্য হাতে কাউকে দেখিয়ে দিচ্ছে। মিলা খুব মিষ্টি হেসে মেয়েটার গালদুটো নেড়ে দেয়। তারপর…তারপর খুব সন্তর্পনে, সেই ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঢিবঢিবানিটা নিয়ে বাচ্চাটির দেখিয়ে দেয়া দিকে পূর্ণচোখ মেলে চাইলো।
অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহি এক যুবক। ঈষৎ অবিন্যস্ত চুল। চোখে ভারী চশমা। আর মুখে লেগে আছে ভারী একটা দুষ্টু দুষ্টু হাসি। মিলার বুকটা একটা অসহ্য ভালোলাগায় টনটন করে ওঠে। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে একে অপরের দিকে। মোটে তো অল্প একটুক পথ। তবু যেন ফুরাতে চায় না। মিলাও চায় না। এত সুন্দর পথচলা যে ওর জীবনে আর আসে নি! আর কখনো আসে নি!
অচেনা যুবক কাছে এসেই ভরাট কন্ঠে বলে ওঠে – ভালো আছো, মিলা!
অস্ফুটে ভালো বলেই চোখ নামিয়ে নেয় মিলা। নত মুখের সেই অনন্য ভঙ্গিমায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে যুবক। প্রেম বোধহয় সর্বকালের আশ্চর্যের একটা বস্তু – কোনো বাঁধাই মানে না!
☼সমাপ্ত☼