অভিমান

ঘড়িতে এগারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট।

লীনার উদ্বেগ বাড়তেই থাকে। ছেলেমানুষি উদ্বেগ। কিন্তু অস্বীকারের উপায়ও নেই! আরমান বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজকে যেন একটু বেশিই আগে ঘুমাতে গেছে। ও নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। চোখ ফেটে কান্না আসে লীনার।

চার রুমের ছিমছাম গোছানো ফ্লাটটিতে বড্ড নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকে লীনা। বাইরের বিনিদ্র ট্রাফিকের একটানা চাপা শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়া নেই। পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে পৌঁছায়। চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। অন্ধকার বারান্দায় চাঁদের রুপালি আলো গলে গলে পড়ছে। মায়াময় সেই আলোতে কেন জানি আরো বিষন্ন হয়ে যায় লীনা।

বেতের চেয়ারে এলিয়ে পড়ে লীনা। বড় ক্লান্ত বোধ করে। এই ক্লান্তিটা দেহের নাকি মনের – ঠিক ঠাহর হয় না। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তো রোজই করে এবং এক ধরণের অভ্যাসও হয়ে গেছে। তবে কি মনে ক্লান্তি?

লীনার বুকে অভিমানের ঝড় উঠতে থাকে। গলায় কী একটা দলার মত আটকে থাকে। গতবার আরমান কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কোনোভাবেই ভুলে যাবে না। আর এমন একটা দিন মানুষ ভোলে কীভাবে? পাঁচটা বছর কি যথেষ্ট নয় একটা বিশেষ দিন মনে রাখবার জন্য?

লীনার এখনো ভালো মনে আছে সেই দিনটির কথা। বাবা কোত্থেকে একটা সরল চেহারার ছেলের সন্ধান এনে হাজির করলেন। লীনার মতই ভালো চাকুরে। লীনার ক্ষনস্থায়ি সব প্রেমই তখন অতীত। না না করেও এবং প্রথমে দেখে গোপনে নাক কুঁচকালেও কেন জানি রাজী হয়ে যায়! চেহারা খানিকটা বোকাটে হলেও চোখগুলো অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল! আর কেমন মায়া মায়া…যেন ডেকে বলছেঃ ‘আমার কেউ নেই, একটু জায়গা দেবে?’

তো জায়গার বন্দোবস্ত খুব শীঘ্রই হয়ে গেলো। তারিখটা ফেব্রুয়ারির একটা বিশেষ দিনে! বন্ধুবান্ধবেরা পঁচিয়ে মারল। তাদের দৃঢ় ধারণা – আগে থেকেই এই পরিচয় – ডুবে ডুবে গভীর দরিয়ার জল পান করেছে ওরা। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। লীনার ব্যাপারটাই যে ওরকম – বড্ড চাপা স্বভাবের।

বিয়ের রাতেই বুঝলো বোকাটে চেহারার ছেলেটি বোকা তো নয়ই, বরং পাজীর চূড়ান্ত! সেদিনও এমন চাঁদনি ছিলো। ছাদের আলাদা করে বানানো দু’টো ঘরে ওদের থাকতে দেয়া হয়েছিলো। তারপর এমন কিছু ঘটেছিলো… সেই মধু মেশানো পাগলামির ক্ষণগুলো স্মরণ করে লীনার এই এখনকার কান্নাভেজা গালও লাল হয়ে উঠলো! অজান্তে বলে উঠলোঃ ‘পাজী কোথাকার!’

আরমানকে ঠিক বুঝে উঠে না লীনা। মাঝে মাঝে মনে হয় এর থেকে অসাধারণ আর কাউকে সে খুঁজে পেত না। আবার কখনো মনে হয় সে কি ভুল করেছে? সব থেকে বিরক্তিকর হলো আরমানের ভুলোমন। তারিখ আর উপলক্ষ্য সে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না। প্রথম প্রথম এসব সহ্য হলেও কয়েকটা বছর পর এসব অসহ্য লাগতে থাকে! সব কিছুই তো পরিবর্তন হয়। তবে, এটা কেন বদলাবে না? বিয়ের তারিখ ভুলে যাওয়াটা কি অন্যায় নয়?

তবে কি অন্য কারণ আছে? হয়তো ওর জীবনে অন্য কেউ ছিলো – বিশেষ কেউ যার কথা সে বেমালুম চেপে গেছে। বাস্তবে এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যেটা একেবারেই বুকের গভীরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করে না! সেরকম কিছু কি তবে? এই জন্যই এত উদাসীনতা? বুকটা আরো বাষ্পোরুদ্ধ হয়ে যায়।

গেল বার এ নিয়ে বিরাট হাঙ্গামা করেছে লীনা। তুমুল ঝগড়া করে আশেপাশের ক’টা শো-পিস ভেঙ্গে বাসা মাথায় তুলেছে। আরমানের প্রায় নতুন ফতুয়াটা এখনও সেই ঝঞ্ঝার সাক্ষ্য বয়ে চলেছে। তবে জয় বরাবরের মত লীনারই হয়েছিলো। আরমান প্রতিবারই নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করেছে। না করে উপায় আছে? নাকে খঁত দিয়ে বলতে হয়েছিলো আগামিবার মনে রাখবেই রাখবে। সেই মুহুর্তে সেই মায়া মায়া চাহনি দেখে পিত্তি জ্বলে গেছিলো লীনার! তবে, ভালোও কি লাগে নি? লোকটা কি জাদু জানে নাকি?

তবে, এই ক্ষণে লীনার চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে আসে – মিথ্যুক কোথাকার! কেমন মরার মত ঘুমাচ্ছে! এবারেও সব ভুলে খেয়ে আছে… উফফ, এ সহ্য করার নয়…

মনে রাখতে চাইলেই মনে রাখা যায়। একটা মোবাইল কোম্পানির এড আছে না… ভুলোমন সঙ্গীটিকে জানিয়ে দেবে বিশেষ বিশেষ দিনের কথা। সেরকম যদি করত! কিংবা ডায়রির পাতায়, ক্যালেণ্ডারে? হ্যাঁ, অনেক উপায় আছে…শুধু ওরই কোনো মাথাব্যথা নাই!

সুন্দর করে সেজেছিলো লীনা। বেশি কিছু করতে হয় নি। সে এমনিতেই সুন্দর। একটা ময়ূরকন্ঠী নীল শাড়ি যে অনন্য যৌবনবতী কবিতা আওড়ে যাচ্ছে, অসামান্য তার আবেদন! আফসোস, যার জন্য এ আয়োজন তাঁরই কোনো বিকার নেই! চোখের কাজল ভারী অশ্রুধারায় গড়াতে থাকে…এই অভিমানের মূল্য কে দেয়?

লীনা উঠে পড়ে। আর কতক্ষণ বসে থাকবে? অনেক রাত হয়েছে নিশ্চয়ই। হ্যাপি নিঃসঙ্গ ভ্যালেন্টাইন এণ্ড আ মিজরেবল এনিভারস্যরি! টলতে টলতে এগুতে থাকে।

হঠাত একটা প্রবল আকর্ষন অনুভব করে লীনা। একজোড়া সবল হাত লীনার সরু কোমরে জগদ্দলের মত চেপে যায়। লীনার পাখি দেহটা একটা ভালুকের ডেরায় অস্বীকারি এক আনন্দে মোচড়াতে থাকে। মায়া চোখের ভালুকটা লীনারই কেনা একটা পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে আছে। তাঁর সাহস দ্রুত বাড়ছে! সে লীনার অভিমানী চোখের জলটুকু শুষে নেয় হাজার রাতের পিয়াসী চাতকের মত। আর তারপর? অশ্রুধারা যে ভরাট ঠোঁটের সঙ্গমে মিশছিলো, বাড়ন্ত সাহসটুকু সেখানে গিয়ে তার নির্লজ্জতা সগৌরবে ঘোষণা করতে থাকে। পাখিটির কোনো আপত্তি ধোপে টেকে না! অবশ্য সে আপত্তির শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলো।

ঘুমাও নি তাহলে? মনে রেখেছো? শয়তান কোথাকার!

অ, তাহলে ঘুমাই গিয়ে আবার? কী ভাবো বলতো? লুকিয়ে লুকিয়ে বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদছিলে? পাগলী কোথাকার! ভালোবাসি কি বলতে হবে? বোঝো না? হ্যাপি এনিভারস্যরি! আর ইয়ে…ঐ যে কী যেন বলে…ধুত তেরি… ভালোবাসাবাসি দিবস… এসো ভালোবাসি… এখন আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও তো!

কীসের পাওনা? বলেই এক ছিটকে বেরিয়ে যায় লীনা – ছুটতে থাকে। পেছনে ভালুকটা ক্ষেপে ওঠে। সারা ফ্লাটে সে দাপিয়ে বেড়ায়…লীনার চাপা হাসি তাকে আরো মরিয়া করে তোলে… অসাধারণ একটা দৃশ্য!

নিচের বাড়িওয়ালা দম্পতি প্রবল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে!

 

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম (ফেব্রুয়ারি ২০১৩)

4 thoughts on “অভিমান

  1. আচ্ছা বাড়িওয়ালা কি ইউ.কে-তে থাকেন আর বিড়াল পায়ে হাঁটাচলা করেন? বাড়িওলাকে মনে হয় চিনি……৷

  2. সবই প্যারেন্টাল গাইডেন্স এবং ১৫ রেটেড … … …। তবে একই দিনে একাধিক উপলক্ষ পড়লে খরচ কিছুটা কমে … …

  3. @ ছড়াবাজ দাদা একই দিনে একাধিক উপলক্ষ্য থাকলে গিফ্ট বাবদ খরচ কমবে এমন কথা দিবাস্বপ্নেও ভাবা উচিত নয়….। বিপদে পড়বেন।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s