অপরিচিত!

জানতে চেয়ো না কে আমি?

কী আমার পরিচয়?
দূর ছাই! কে আমি তা নিজেই জানি নাকি?
কোথায় যে আমার বিষয়-আশয়?

মাঝে মাঝে অস্পষ্ট আয়নাটিতে কিংবা
দুলকি চালে চলা ট্রেনের আধ-ঘষা কাচে
নিজেই নিজের বিম্ব দেখি।
দূর ছাই! সেটা নাকি বিম্ব নয়, প্রতিবিম্ব!
তাহলে বিম্বটাকেই শুধোই…
কে হে তুমি? কী চাও বারে বারে?
বিম্বটা, নিয়ে একরাশ বিস্ময়ের ঘনঘটা
প্রশ্নটা যায় পাশ কাটিয়ে – সুচতুরে।
ভেদে গিয়ে নির্বিবাদে
প্রতিবিম্বের দুরুদুরু আত্মা মাঝে
আঁতিপাঁতি খোঁজে দ্বিধান্বিত ছায়ার বিব্রত চারিপাশ!
পাবে কী করে? কে পেয়েছে সহজে কোন্‌ কালে?
মহাকালের মত প্রাচীন প্রশ্নটা যে শূন্যতার জলরং
গায়ে মেখে ঝিমোয় টানাপোড়েনের
অর্থহীন বাহাসে!
দূর ছাই! সেটি নাকি বাহাস নয়, আত্মানুসন্ধান!
বলে গুণীজনে।
হবে হয়তো। তবে সেই সন্ধানের ম্লান-মধুর আলোয়
নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে দু’টো
অনাদির জিজ্ঞাসু মুখ।
কত কালের চেনা, তবুও যেন
কী অদ্ভূত অপরিচিত!

জানতে চেয়ো না কে আমি?
নিজেই নিজের কাছে যে বড্ড অচেনা!

প্রথম প্রকাশঃ প্রজন্ম ফোরাম  (২৮/০৭/২০১১)

একবার বনভোজনে…

১.

আরে ভাই, একটু জোরে চালান না!
আর কত জোরে চালামু, আপা? আমি তো পঙ্খিরাজের ড্রাইভার না।
সে আমি কী জানি। বেশি কথা না বলে একটু তাড়াতাড়ি করেন না!

উদ্বিগ্ন মুখে দীপিন্তি ঘড়িটা দেখে। ইস, বড় দেরী হয়ে গেলো! ৯ টায় ছাড়বে বলেছিলো। এখন ন’টা বেজে ৩৬ মিনিট। পিকনিকের বাসটা কি ওকে ছেড়ে চলেই গেলো নাকি! কত আশা করে কত কী করবে ভেবেছিলো, সব ভেস্তে যেতে বসেছে! বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে ওর মসৃণ কপালে, চিবুকে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করতে থাকে।

সবই ঠিক ছিলো। ঘড়িতে এলার্মও দেয়া ছিলো। সকাল ৬টায় উঠে তৈরি হবে। কিন্তু সকালে সে কিছুতেই উঠতে পারে না। এলার্ম শুনেও ঘুমের ঘোরে টেবল ঘড়িটার টুটি চেপে ধরেছিলো। ফলাফলঃ ৮ টায় উঠে দৌঁড়-ঝাঁপ। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কিনা, কে জানে?
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রিক্সাটা ডিপার্টমেন্টের ফটক ধরে গলতে থাকে। ভয়ে ভয়ে ইতি-উতি একটা বাস খুঁজতে থাকে। বাসের মুখে একটা ব্যানার ঝুলবে। ও নিজেই লিখেছে। কত কাজ করেছে এই পিকনিকের জন্য। অথচ তারই যাওয়াটা ভণ্ডুল হয়ে যায় নাকি? মোবাইলটাও এই সময়ে চার্জ খুইয়ে বসে আছে। জয়িতা দিদিকে শুধু বলতে পেরেছিলো ওকে ছেড়ে যেন না যায়…অপেক্ষা করে। সে কি সবাইকে এতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে?

ভাড়াটা মিটিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজেও কোনো বাস দেখতে পেলো না। দুঃখে কান্না আসি আসি করছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য হাত কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কাউকে কি জিজ্ঞেস করবে? এমন সময় মেইন বিল্ডিং-এর পেছন থেকে কারা যেন হেঁকে উঠলো, ‘এই যে লেইট লতিফা বেগম, এই দিকে আয়…কানা নাকি? চোখে দেখিস না!’

দীপিন্তির বুকে রক্ত ছলকে উঠে। বকা খেয়েও হাসতে হাসতে দৌঁড়াতে থাকে। তাহলে ওরা ওকে ছেড়ে যায় নি!

বাসের দরজায় জয়িতা দাঁড়ানো। দুই ইয়ার সিনিয়ার। অগ্নিশর্মা মূর্তি!
তোকে ধরে চাবকানো উচিৎ! কী করছিলি এতক্ষণ? বাস কি তোর জন্য পুরা দিনটা বসে থাকবে? কেলাস কোথাকার!
রাগ করো না, জয়িদি। আমি জানতাম তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমার লক্ষ্মি আপু!
ন্যাকামো রাখ। এখন সীটে বসে আমাকে উদ্ধার কর। ক’বে যে পাংচুয়ালিটি শিখবি!

বসবার জন্য জয়িতা সামনে তাকিয়ে দেখেঃ সবার মুখে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঝুলছে। কারো মুখে রাগ, কারো মুখে বিরক্তি, কেউ কেউবা বেশ উদ্বিগ্ন। কিন্তু সব ছাড়িয়ে সবার মাঝে একটা সূক্ষ্ণ কৌতুক কি খেলা করছে? ওর ভুলও হতে পারে। কিন্তু কেন?

কারণটা খুব দ্রুতই বুঝতে পারলোঃ বাসে কোনো আসনই আর ফাঁকা নেই! সবাই সবার পছন্দের মানুষের সাথে বসে গেছে। জয়িদির জন্যও অসীমদা অপেক্ষা করছেন। শুধু একটা আসনই বাকী। কিন্তু যার পাশে বসতে হবে, সেটা দেখে রাগে গা জ্বলে গেলো! আজকের দিনটাই কুফা!

জয়িদি, আমি মরে গেলেও ঐটার পাশে বসবো না! চাপাস্বরে দীপিন্তি ফুঁসে ওঠে।
ছিঃ, এভাবে বলে না দীপি! সিন ক্রিয়েট করিস না। এমনিতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। নে, বসে পড়তো। মাত্র দু’ঘন্টার পথ। দেখতে দেখতে চলে যাবে। তাছাড়া শৈবালকে যা ভাবিস, ও মোটেও তেমনটা নয়!

এই মুহুর্তে দীপিন্তির সহযাত্রি নিজের নামটা শুনে একটা বেজায় ঘোর থেকে যেন উঠে আসে। কী ভাবছিলো, কে জানে? মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পরনে একটা খদ্দেরের পাঞ্জাবি আর ব্লাক জিন্স। চৌকো মুখে একটা তিরিক্ষি রাগ খেলে গেলেও চোখজোড়া কেমন যেন অদ্ভুত স্বপ্নালু! পুরো ডিপার্টমেন্টে দীপিন্তির একমাত্র বিখ্যাত শত্রু – শৈবাল অরিত্র!

আমি বাঘও না, ভাল্লুকও না। আমার পাশে বসলে কারো মান যাবে না। আর যদি যায়ই তো…জয়ি, আয় তুই বস আমার পাশে।
গমগমে কন্ঠে বলে ওঠে শৈবাল।

অ্যাঁ, তাহলে অসীম বসবে কার সাথে? জয়িতা খাবি খায়।
ওদিকে অসীমের মুখ ছাই হয়ে গেলো। নিজের প্রেমিকার সাথে কে-ইবা না যেতে চায়? দীপিন্তি সব দেখেশুনে অগত্যা রাজী হয়ে যায়। গজগজ করতে করতে ধপাস করে বসে পড়ে শৈবালের পাশটিতে।

এখন খুশি তো! যাও গিয়ে বসো। তোমরা সবাই ষড়যন্ত্র করে এই ব্যবস্থা করেছো। বুঝি, আমি সবই বুঝি। আ বাঞ্চ অব ক্রিমিনাল মাইন্ডস!

জয়িতা হাসি হাসি মুখে চলে যায়। রাগে পিত্তি জ্বলে গেলেও কিছুই করার থাকে না দীপিন্তির।

সরে বসেন। এত ঘেঁষে বসেছেন কেন?
কোথায় ঘেঁষে বসলাম? আজব তো! খামোখা বাজে কথা না বললেই কি নয়!
আমি জানালার পাশে বসবো। জানালার পাশে ছাড়া আমি বসতে পারি না।
আমারও জানালার পাশে ছাড়া ভালোলাগে না। শৈবাল ঘোষণার ভঙ্গিতে বলে।
ম্যানারলেস, রুড! কীভাবে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হয়, তা-ই জানে না।
জানার দরকারও নেই! ঐ লেসন মরিচমুখি কারো কাছে থেকে আমার শিখতে হবে না।
কী! ঠিক আছে, দরকার নেই আমার জানালার পাশে বসে। আপনিই বসেন। গুম হয়ে থাকে দীপিন্তি।

বাসটা চলতে থাকে। বাইরে চৈত্রের সূর্যটা তার ভেল্কি দেখাতে শুরু করেছে। চড়চড় করে তাপ বাড়ছে। পথের দু’ধারে আম আর কলা গাছের সারি একমনে দেখছিলো শৈবাল। একটা হালকা মিঠে গন্ধ আসছে। কোথায় যেন আমের বোল ফুটেছে। সাথে পাশে বসে থাকা মেয়েটির ব্যবহার করা একটা হালকা পারফিউমের গন্ধ। ঠিক কোনটা যে ওর ভালো লাগছে, সেটি ঠিক ঠাহর করতে পারছে না! হঠাত সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

বসো, জানালার পাশে গিয়ে বসো।

অবাক হয়ে গেলেও দীপন্তি সরল মনে জানালার পাশে গিয়ে বসে। রোদ বেশ কড়কড়ে হয়ে উঠেছে। একেকটা আগুনের গোলা যেন দীপিন্তির ফর্সা মুখে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকলো। শৈবালের মুখটা কি একটু হাসি হাসি? যে রাম গরুড়ের ছানা…এর মুখে তো হাসি থাকার কথা না!

চালটা বুঝে যায় দীপিন্তি। গরমে পুড়িয়ে মারার ধান্দা। কিন্তু এখন কিছুতেই সে সেটা স্বীকার করবে না। শত্রুকে আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দেবার কোনো ইচ্ছেই আপাতত নেই। কিছুটা সময় সে গ্যাঁট হয়ে বসে বসে পুড়তে থাকে। শেষটায় না পেরে জানালার পর্দাটা ধরে টানাটানি করতে থাকে। পর্দাটাও এমন…ঠিক সময়ে এমন গিট্টু নিয়ে ঝুলছে যে দীপি কিছুতেই কায়দা করে উঠতে পারলো না। ধ্যাত! দিনটাই খারাপ আজকে।

আড়চোখে সবই দেখছিলো শৈবাল। নীল-সাদা একটা চমৎকার শাড়ি পরেছে দীপিন্তি। সেটার আঁচলটা জানালার হাওয়ায় উড়ে এসে শৈবালের চোখে আছড়ে পড়ছে। এবার যেন একটু মায়া হয়ে যায় দাঁড়িয়ে যুঝতে থাকা মেয়েটির জন্য। হাত বাড়িয়ে দীপির নীল রেশমি চুড়ি ছুঁয়ে নামিয়ে আনে আসনে। তারপর জানালার পর্দাটা ঠিক করে দেয়। অপ্রস্তুত হয়ে যায় দীপিন্তি। ভেতরের কোলাহল কি ক্ষণের জন্য থেমে যায়? তারপর একটা চাপা হাসি… সব ষড়যন্ত্র…দীপি দুঃখে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

২.

গাড়িটা এখন গন্তব্যের মধ্য পথে। একদফা চা-নাস্তা হয়ে গেছে। কেউ কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে। পিছনে কেউ একজন গীটারে সুর তুলেছে। তুমুল হাসাহাসি চলছে। এক কথায় চমৎকার পরিবেশ। কিন্তু ওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই শৈবালের। সে একটা নোটবুক বের করে গুটি গুটি কী যেন লিখছে। দীপিন্তি সেদিকে তাকিয়ে সন্তর্পনে একটা ভেংচি কেটে ওঠে। ভাবেঃ যে না বাজে আচার-ব্যবহার, তার আবার কবিতা লেখা!  জানে সে কবি, কিন্তু কখনো তার কবিতা পড়া হয়ে ওঠে নি। বিশেষ করে সেই দিনের পর আর রুচি হয় নি! সেই দিনটা সে ভুলে যেতে চায়।

দেখতে দেখতেই ঘন্টা দুই কেটে গেলো। সবাই হৈ হৈ করতে করতে নেমে পড়ে। অত্যুৎসাহিদের ফটোসেশান দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে যায়। জায়গাটা একটা প্রসিদ্ধ পিকনিক স্পট। যে যার কাজে নেমে পড়ে। রান্নার জন্য বাবুর্চি ভাড়া করা হয়েছিলো। ওরা হাঁকডাক করে হাঁড়িকুড়ি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শৈবাল এই কাজটা তদারক করে। কোথায় চুলা পাতা হবে, কী কী রান্না হবে ইত্যাদি ঝামেলা শেষ করে সে ছায়া দেখে একটা গাছের নীচে এসে বসে। ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে চলে। দৃষ্টিটা খানিক দূরে ঐ নীল-সাদার উপরে গিয়ে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।

আচ্ছা, দীপিন্তি ওকে এতটা কষ্ট দেয় কেন? কেন এতটা ঘৃণা করে? সে কি ঘৃণা পাবার মত কেউ? হতে পারে সে একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে এমন শত্রু হতে হবে? সেই দিনটা এখনও ভালো মনে আছে।

ফার্স্ট ইয়ারে একটা অসামান্য সুন্দরী মেয়ে এসেছে। সুন্দরীদের আগমনের বার্তা সুপার সনিক বেগে ধায়। শৈবালও না চাইলেও পেয়ে যায়। প্রথম যেদিন দেখেছিলো, বুকের কোথাও যেন একটা অসহ্য ব্যথার গোঙ্গানি শুনতে পেয়েছিলো! পেতে চেয়ে যে অনন্য ব্যথা যুগ যুগ মানুষকে কাঁদিয়ে যায়, সেই ব্যথায় ডুবে গিয়ে শৈবাল অরিত্রের কলম যেন রজস্বলা কুমারির মত অজানা উচ্ছ্বাসে কবিতার ফুল ফুটিয়ে চলল।

শৈবাল অকপট চরিত্রের। চিরদিন ওর যা ভালো লেগেছে, সেটা বলতে কখনোই দ্বিধা করে নি! দীপিন্তির সব থেকে ভালো লেগেছিলো ওর ঠোঁটজোড়া! যখনই দেখা পেতো, কিংবা দূর হতে দেখতো…সে কেবল সেটাই দেখতো। কেমন অদ্ভুত ছন্দে স্পন্দিত হয়! যখন কথা বলে, হাসে, রেগে যায় কিংবা ঠোঁট কামড়ে তন্ময় হয়ে লেকচার শোনে… শৈবাল পাগল হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে একটা উত্তাল কামনা অন্ধ আবেগে উদ্ধত হয়ে উঠতে থাকে।

একদিন সুযোগ বুঝে বলেই ফেলে। সোজাসাপ্টা চাওয়ার কথা। হতচকিত দীপিন্তি সেসবের জন্য তখনও প্রস্তুত ছিলো না। পড়াশোনা ছাড়া মাথায় আর কিছুকেই প্রাধান্য দিতে চায় নি। প্রত্যাখানের আঘাতে বিহ্বল হয়ে পড়ে শৈবাল। শেষে সেই ভুলটা করে ফেলে। ভালোবাসা না পাক, অন্তত সেই ঠোঁট জোড়ার স্পর্শ পেতে চায় সে। হয়তো সেটি নিয়ে কাটিয়ে দিতো যুগ যুগান্তর! কবির সেই আবেগের সরলত্ব সেদিন বুঝতে পারে নি দীপিন্তি। মনের ঘরে জবরদস্তি চলে না। প্রচণ্ড রাগে, ঘৃণায় একটা চড় কষিয়ে দেয় শৈবালের গালে। তারপর তো শুধুই রেষারেষির ইতিহাস! সে কথা মনে পড়তেই মুখটা তেতো হয়ে গেলো।

ভাবনার জাল কেটে গেলেও সেই অপমানের রেশে গালে হাত বুলাতে থাকে শৈবাল। সিগারেটটা কখন নিভে গেছে! চমক ভাঙ্গে যুবিনের ডাকে।
কী রে, এরকম হা মেলে আছিস কেন? খাবার রেডি হয়ে গেছে। আয়, অনেক কাজ বাকী। পরিবেশনটা করতে হবে তো!
হ্যাঁ, কী বললি? ওঃ, চল, চল। স্যরি দোস্ত!

খাবার পরিবেশন করছে জয়িতা আর শৈবাল। সবাই একে একে এসে পছন্দমত খাবার নিয়ে যাচ্ছে। দীপিন্তির নেবার সময় শৈবাল থালাটা অনিচ্ছাকৃতভাবে একটু বেশি সময়ই ধরে রাখে। অনেকদিন বাদে পুরোনো ক্ষতটা কেন যেন পোড়াচ্ছে! সে দীপির চোখে চেয়েই নামিয়ে ফেলে…জয়িতা ব্যাপারটা বুঝে কেমন যেন হাসতে থাকে…

কী রে শৈবাল, থালাটা ছাড়। মেয়েটাকে আর কত আটকে রাখবি?
শৈবাল লজ্জা পেয়ে যায়। কিন্তু দীপিন্তির চোখ রাগে জ্বলতে থাকে – সব জায়গায় অসভ্যতা!

খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে অনেক আগে। মেয়েরা সবাই একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। এ কথা সে কথায় দীপিন্তি সেই প্রসঙ্গে জয়িতাকে ধরে ফেলে।
জয়িদি, এটা কিন্তু তোমার করা একেবারেই ঠিক হয় নাই?
কী ঠিক হয় নাই?
ন্যাকামি করবে না। তখন ঐ শৈবালকে নিয়ে কেন ওরকম করেছো? জবাব দাও।
আরেব্বাহ! তোমরা ডুবে ডুবে জল খাবে, আর আমরা একটু বললেই যত দোষ! আমাদের কি অন্ধ পেয়েছিস নাকি? আমরা কিছুই জানি না, না?
কী জানো?
জানি শৈবাল তোকে কতটা চায়। সে ঐ গরুটার চোখ দেখলেই বোঝা যায় রে! আহাম্মকটা এত স্পষ্টবাদি হয়েও কেন সে কথা এতদিন তোকে বলে নি! কী আশ্চর্য! আর তোদের ঝামেলাটা ঠিক কী, বুঝি না। কেন এরকম দা-কুমড়া সম্পর্ক?
সে বুঝে তোমার কাজ নাই।
তবে তুইও চুপ করে থাক। আমার তো মনে হয়… তুইও…
খবরদার জয়িদি। বাজে কথা বলবে না।
ওরে বাবা! তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলি দেখি! কিন্তু শৈবাল কিন্তু আসলেই তোকে ভালোবাসে…
মানে?

সে কথার জবাব জয়িতা দেয় না। কিছু একটা নিয়ে সে মেয়েদের সাথে নিচুস্বরে কথা বলে যায়। দীপিন্তি অনবরত মাথা নাড়তে থাকে।

এদিকে ছেলেরা তাস খেলছিলো। কেউবা ধোঁয়ার সাথে নিবিড় সখ্যতায় মত্ত ছিলো। মেয়েদের দলটাকে ঐ জংলা দিকটায় যেতে দেখেছে। যাক ঘুরে বেড়াক যেদিকে খুশি। যদিও অসীমের তাতে খুব একটা সায় ছিলো না। জয়িকে নিয়ে আর আদিখ্যেতার সীমা নেই। কিছুটা ওভার প্রটেক্টিভও। যাই হোক, হঠাত একটা চাপা চিতকারে অসীমের পিলে চমকে যায়। এ যে জয়ির কণ্ঠ! অসীম খেলা ফেলে জংগল অভিমুখে দৌঁড় লাগালো। দেখাদেখি সবাই উঠে ছুটে চলল।

মেয়েদের জটলার ভেতরে দীপিন্তি শুয়ে আছে। কেমন একটা নিস্তেজ ভাব। সবাই উদ্বিগ্নমুখে ঝুঁকে দেখছে। জয়িতা বিলাপ করে চলেছে। দীপিন্তিকে নাকি সাপে কেটেছে!!

শৈবাল আর সবার মত উৎসুক হয়ে ঘটনা শুনছিলো। দীপিন্তি শব্দটা কানে যেতেই যেন শরীরটা অবশ হয়ে এলো। জংলা জায়গায় কী না কী সাপে কাটলো! দুর্ভাবনায় পায়ের নীচে মাটি যেন সরে গেলো। কিন্তু ওকে শক্ত হতে হবে। বিলাপের সময় এখন নয়। বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে। জায়গাটা চেনা। স্থানীয় হাসপাতাল খুব বেশি দূরে নয়।

ঘোরের মাথায় শৈবালের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। সে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে একটানে দীপিন্তিকে কোলে তুলে নিয়ে বাসের দিকে ছুটতে থাকে। পিছে পিছে সবাই। শৈবাল যেন অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে।

বাসে গিয়ে দেখেঃ স্টিয়ারিং –এ অসীম বসে আছে।

অসীম, ড্রাইভারকে ডাক তাড়াতাড়ি। দীপিন্তিকে বাঁচাতে হবে রে!
কেন মামা, আমি চালালে হবে না? আমি চালায় নিয়ে যাই?
শৈবালের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
ফাজলামি করিস আমার সাথে। জীবনে গাড়ি চালিয়েছিস কখনো? একটা সাইকেলও তো চালাতে দেখলাম না কোনোদিন!
আরে বলদ, রাগ করিস কেন? শিখায় দে, এখন শিখে চালায় নিয়ে যাবো…
রাগে কাঁপতে থাকে শৈবাল। দীপিন্তি কোলে না থাকলে এই মুহুর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তো এইরকম চোখে তাকিয়ে থাকে। ততক্ষণে সবাই জড়ো হয়েছে চারপাশে। দৃশ্য জমে উঠেছে। পিনপতন নিরবতা।

হঠাত খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে দীপিন্তি। অনেকক্ষণ চেপেছিল, আর পারলো না!  তারপর জয়িতা, অসীম এবং একে একে সবাই!
আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় শৈবালের। হঠাত সব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ সবই অভিনয়। দীপিন্তিরা যে ওদের ডিপার্টমেন্টের নাটকের দলে আছে। সবাই ওকে কীরকম বোকা বানালো? লাজুক বোকা বোকা হাসতে থাকে। আর একটা চাপা রাগও চোয়ালে কিড়মিড় করতে থাকে!

‘এখনও কোলে নিয়ে আছিস দীপিকে? ওরে নামিয়ে রাখ রে!’ জয়িতা সরব হয়।

ধপাস করে একটা শব্দ হয়। দীপিন্তি মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে। আরো একবার হাসির রোল ওঠে। এবারে দীপিন্তি লজ্জা পেয়ে যায়।

দিনের আলো নিভে আসছে। সবাই গোছগাছ করছে। ফেরার সময় হয়ে এসেছে। শৈবাল গম্ভীর মুখে সিগারেট টানছিলো। হঠাত কাঁধে একটা কোমল হাতের স্পর্শ এসে লাগে। মুখ ঘুরিয়ে দেখে দীপিন্তি এসে দাঁড়িয়েছে।

রাগ করেছেন? আমি আসলে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
আমাকে এভাবে বোকা না বানালে কি চলতো না, দীপি?
আমি মানে… জয়িদির চাপে পড়ে…প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
কী, বাজী হয়েছিলো ভালোবাসি কিনা? কেন তুমি বোঝো না?

দীপিন্তি কিছু বলে না। চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। শৈবাল পিছু ফিরে দীপিন্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়। বেলা শেষের রাঙা আলো পড়েছে দীপিন্তির মুখের একপাশে। একতাল টানটান চুল মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। শৈবাল আলতো করে চিবুক ধরে নত মুখ তুলে আনে।

তাকাও আমার দিকে। কেন এত ঘৃণা করো আমাকে? আমি কি এতটাই তুচ্ছ? একটা ভুলের জন্য কেন এত শাস্তি দিচ্ছো?
দীপিন্তি কিছু বলে না। শুধু ওর ভরাট ঠোঁট লুকানো আবেগে তিরতির কাঁপতে থাকে। শৈবাল সেখানটায় আঙ্গুল রেখে নিজের ঠোঁটে ছুঁয়ে ফেলে।

সবাই একে একে বাসে উঠছে। শুধু দীপিন্তি আর শৈবালকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জয়িতা যথারীতি রাগে গড়গড় করছে – আক্কেল হলো না মানুষের! নো পাংচুয়ালিটি এটঅল!

এ মা! কী বিচ্ছিরি সিগারেটের গন্ধ…ছাড়ো বলছি। জংলি কোথাকার! অবশ্য দীপিন্তির অভিযোগে জংলি কেউ পাত্তা দিলে তো! দিনের আলো নিভে এলেও বনভোজনটা এবার যেন মিলনের রঙ্গে সত্যিকারের রাঙা হয়ে উঠলো!

সমাপ্ত

দোচালার এরিয়ালে নিঃসঙ্গ এক বন্ধুকে…

দোচালার এরিয়ালে নিঃসঙ্গ এক পাখ,
রোজ ভোরে তোমায় দেখি দাঁড়িয়ে এক ঠাঁয় – নির্বাক!
ইদানীং বিষন্ন রাতের মত ফোটে বিষন্ন প্রাতও
মেঘভারে মনভার আর
বাদলের দাগে ফোটে বিগত রাতের আঘাত যত!
রোজ রোজ তোমায় দেখি স্বচ্ছ জান্‌লা গলিয়ে – বরাবর।
মৌনতায় ঋদ্ধ, দৃষ্টি অগমে –ছাড়িয়ে দিগন্তের পাড় ।
জানো, তোমার মতই নেই কেউ আমার,
পাশে বসে দু’দণ্ড কথা বলবার।
তাই নীরবই থাকি।
তুমি এরিয়ালে, আমি এপাশে জান্‌লার।

দোচালার এরিয়ালে একাকীত্বের এক পাখ,
আফোটা আলোয় তোমায় ঘিরে থাকে যত আঁধারের ঝাঁক!
তোমার মাঝেই খুঁজে পাই আমার আমিকে –
প্রাতের নিঃসঙ্গ কবিকে…
তাই কখন যে বসে যাই তোমার পাশটিতে,
বন্ধুতার চিরায়ত আঙ্গিকে!

দোচালার এরিয়ালে হররোজের জবুথবু অচেনা পাখ,
চলো, খুলে দেই ঝাঁপি –
মিটে যাক আপন আপন ব্যর্থতার দুর্বহ দুর্বিপাক!
এসো কথা কই –
চঞ্চল হই নৈ:শব্দের দৃঢ় ভাষায়, ব্যথাতুর ব্যঞ্জনায়…
এসো বন্ধু হই, মিলি রোজ প্রাতে –
একটু হলেও ফুটুক আলো আমাদের নিত্যকার বিষন্ন সভায়!